বাংলা ভাষার ‘প্রথম’ নিদর্শন গীতগোবিন্দ কাব্য

        

        জানি না বাংলা ভাষার ‘প্রথম’ নিদর্শন হিসেবে কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের উল্ল্যেখ করাটা ঠিক হচ্ছে কিনা। কিন্তু চর্যাপদের সময়কাল যদি অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী হয় তাহলে বলা যেতেই পারে গীতগোবিন্দ কাব্য প্রায় সেই সমসাময়িক কালেরই রচনা। আমরা জানি, বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় কালিদাস প্রমুখ সভাকবিদের মত রাজা লক্ষণ সেনও তাঁর সভায় পাঁচজন সভাকবি রেখেছিলেন এবং তন্মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ছিলেন কবি জয়দেব। রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকাল ছিল ১১৭৮ থেকে ১২০৬ সালতাহলে আমাদের অনুমান করতে দ্বিধা নেই যে, কবি জয়দেব একাদশ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কালেই তাঁর গীতগোবিন্দ কাব্য রচনা করেছিলেন।

       গীতগোবিন্দের সময়কালকে আমরা আরও একটু সুক্ষভাবে নির্ণয় করতে পারি। কবি তাঁর কাব্যের শুরুতেই তাঁর সময়কার গুনী কবিদের কাব্য রচনা-কৌশলের কথা উল্ল্যেখ করেছেন। তাঁর কাব্যপংক্তিতে যে চারজন কবির স্মরণ নিয়েছেন সেই চারজনই ছিলেন রাজা লক্ষণ সেনের রাজসভার পঞ্চরত্নের (গোবর্দ্ধন, শরণ, জয়দেব, উমাপতি এবং ধোয়ী) চার রত্ন। এখান থেকেও বিচার্য হতে পারে যে, যেহেতু কবি জয়দেব রাজা লক্ষণ সেনের রাজসভার সভাকবি ছিলেন এবং সেখানেই বাকী সভাকবিদের কাব্য রচনার সাথে তাঁর বিশেষ পরিচয় ঘটেছে; সেই হিসেবে তাঁর কাব্যগ্রন্হে এই কবিদের উল্ল্যেখ থেকে এটা ধারণা করা অসমীচীন হবে না যে, গীতগোবিন্দ একাদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে দ্বাদশ শতকের প্রথম ভাগের মধ্যবর্তী কোনো একটা সময়ের রচনা। 

       জয়দেবের জন্মভূমি হিসেবে আমরা সকলেই কেন্দুবিল্ব গ্রামকেই জানি যেটি কালপরিক্রমায় আজ কেঁদুলি নাম পরিগ্রহ করেছে। জায়গাটি বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার অন্তর্গত। সেই হিসেবে তিনি অবশ্যই একজন বাঙালী কবি।

       যা হোক্‌, প্রসঙ্গক্রমে আমরা জানি ‘চর্যাপদ’ রচিত হয়েছে সান্ধ্য ভাষায় যেটি মূলত বাংলা, অহমিয়া, ওড়িয়া ভাষার পূর্ববর্তী ভাষা হিসেবে স্বীকৃততাই সান্ধ্য ভাষাকে পুরোপুরি হয়তো বাংলা ভাষা বলা যাবে না ঠিক কিন্তু বাংলা ভাষার পূর্বসূরি হিসেবে ‘চর্যাপদে’র ভাষাকে তো আমরা ধরতেই পারি। কেন ধরতে পারি তার কারণ হিসেবে শুধু এটুকুই উল্লেখ্য যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর অনুবাদ গ্রন্হটিরও নাম দিয়েছেন হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা এবং চর্য্যাচর্যবিনিশ্চয় –এর অনুবাদ কর্মে তিনি একে ‘বৌদ্ধ সহজিয়া মতের অতিপুরাণ বাঙ্গালা গান’ বলে উল্ল্যেখ করছেন।

       এবার তাহলে শ্রীচৈতন্যভাগবত এবং মঙ্গলকাব্যকে যদি আমরা বাংলা ভাষার নিদর্শন হিসেবে দেখাতে চাই সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠে গীতগোবিন্দকে তাহলে আমরা কোথায় রাখব। শ্রীচৈতন্যভাগবতের সময়কাল যদি ষোড়শ শতাব্দী হয় এবং মঙ্গলকাব্যের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সময়কাল যদি ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী হয় তাহলে গীতগোবিন্দ যে এসবের আগেই রচিত হয়েছে সে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

       তাহলে তো প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, কোন্‌ ভাষায় গীতগোবিন্দ রচিত হয়েছে? এ প্রসঙ্গে নৃপেন্দ্রকিশোর চট্টোপাধ্যায় তাঁর চিত্রে জয়দেব ও গীতগোবিন্দ নামক গ্রন্হের তৃতীয় খণ্ডে “সাহিত্য হিসাবে গীতগোবিন্দ” নামক প্রবন্ধে লিখছেন, "...জয়দেবের গীতগোবিন্দকাব্য সংস্কৃত সাহিত্য আর দেশজ প্রাকৃতভাষার সাহিত্যের সন্ধিক্ষণে বিরাজ করছে। গীতগোবিন্দর ভেতর যেমন একদিকে দেখা যায় বহুকাল বহমান সংস্কৃত ভাষার শেষ-বিবর্ত্তনের রূপ, তেমনি তার মধ্যে দেখা যায় নতুন বাংলা সাহিত্যের জন্মের সূচনা। গীতগোবিন্দের ভাষার সঙ্গে কালিদাস ভবভূতির ভাষার পার্থক্য পড়তে গেলেই চোখে পড়ে। গীতগোবিন্দের বহু শ্লোকে সংস্কৃত-ব্যাকরণের চিহ্ন প্রায়ই চোখে পড়ে না, দু-একটা অনুস্বার আর বিসর্গ বাদ দিলেই সেটা বাংলা ভাষার মতনই শোনায়" (২৬৪)।

       আমরা সকলেই জানি ভাষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। হঠাৎ করে কোনো ভাষার উৎপত্তি ঘটেনা। কালের পর কাল ধরে মানুষের মুখে মুখে ভাষা বাহিত হতে থাকে। তেমনি বাংলা ভাষাও মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে হয়ে কালে কালে তা লেখ্যরূপ ধারণ করেছে। তৎকালে সাধারণের মৌখিক ভাষা হিসেবে প্রাকৃতের (বাংলা ভাষার আদিরূপ) চল থাকলেও লেখ্যরূপে কিন্তু শুধু সংস্কৃতই ব্যবহৃত হত। কারণ সংস্কৃত ভাষার শুদ্ধ ব্যকরণ ছিল এবং তা লেখার জন্য খুবই আলংকারিক একটি ভাষা ছিল।

       কিন্তু, আমরা সকলেই জানি, ভাষা একটি স্বতস্ফূর্ত ভাবপ্রকাশের মাধ্যম যেটি কালের পরিক্রমায় পরিবর্তিত হতে হতে সামনে এগোয়। আজ হতে দশ বা কুড়ি বছর আগে আমরা যে ভাষা-ভঙ্গীতে কথা বলতাম এখন কি আমরা সেই একই ভাষা-ভঙ্গীতে কথা বলি। অবশ্যই নয়; আমরা তার থেকে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছি। আর এভাবেই সাধারণ জনের মুখে মুখেই ভাষা জিইয়ে থাকেসংস্কৃত তো সাধারণের মুখের ভাষা ছিল না, ছিল লেখ্য ভাষাআর বাহিত না হওয়ার কারণে তার কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। এভাবে চলতে চলতে একসময় মৌখিক ভাষার সাথে তার অনেক দুরত্ব তৈরী হয়েছে; আর তাই, ভাষা হিসেবে সংস্কৃত এখন শুধু পুঁথির পাতাই অলংকৃত করে আছে মাত্র।

পরিশেষে বলতে চাই, আমি ভাষাবিদ বা সাহিত্য বিশারদ নই। তবে নিজের মাতৃভাষার একটি ক্রমইতিহাস জানার প্রচণ্ড আগ্রহ আগ্রহ থেকেই এই লেখনীর সূত্রপাত। চর্যাপদ এবং গীতগোবিন্দের মধ্যবর্তী কোনো সাহিত্যগ্রন্হ উপলব্ধ কিনা তা আমার জানা নেই। সে বিষয়ে যাদের বিশেষ পাণ্ডিত্য আছে তারাই সঠিক বলতে পারবেন। সেই দায় আমি তাদের উপরেই দিলাম। আর এই অন্তে নৃপেন্দ্রকিশোর চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্য গ্রহণপূর্বক আমরা এমত সিদ্ধান্তে আসতেই পারি যে, গীতগোবিন্দ তার চলনে সংস্কৃত ভাষা এবং তার কাঠামো অনুসরণ করলেও সেখানেই প্রথম লেখ্য রূপে বাংলা ভাষার প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলে মনে হয়।  

Comments

Popular posts from this blog

নাট্য আলোচনা - রাজা

Book Review: প্রগতির চেতনা প্রগতির পথিকেরা

জামাইষষ্ঠীর ইতিহাস

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ‘প্রতীক’ (The Logo of IPTA)

আমার মা

ঘরোয়া সিরিজ: শুচিবায়ী বাঙালী