নাট্য আলোচনা - রাজা
প্রযোজনা: নাট্যকলা বিভাগ, সংগীত ভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন
Play Text বনাম Performance
Text: রবীন্দ্রনাথের রাজা
বিভাস বিষ্ণু চৌধুরী
বিভাস বিষ্ণু চৌধুরী
আমরা সবাই রাজা আমাদের
এই রাজার রাজত্বে –
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্ত্বে?
‘স্বদেশ’ পর্যায়ের এই গানের পিঞ্জরেই
বাঁধা রয়েছে রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকের সুর। এর মর্মার্থই রাজা
নাটকের অঙ্গশোভা।
গত ২৭শে মার্চ ‘বিশ্ব নাট্য দিবস’-এর
উদ্যাপন উপলক্ষ্যে বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনের ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত, নৃত্য ও নাট্য’
বিভাগের একটি ছোট্ট ইউনিট ‘ড্রামা এণ্ড থিয়েটার আর্টস’ সারা দিন ব্যাপি ‘লিপিকা’
প্রেক্ষাগৃহে নাট্য বিষয়ক সেমিনার এবং সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজা
নাটকটি মঞ্চস্হ করে। নাটক নিয়ে কেউ মতামত জানতে চাইলে এককথায় বলা যায়, “It’s a heroic attempt of Drama unit”। নিতান্ত আনকোড়া কিছু নবিশ ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে
রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকটিকে মঞ্চস্হ করা রীতিমত একটি চ্যালেঞ্জ। মোটামুটি ২০০০
সালের পরে যতদূর মনে পড়ে নাটকের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে নাট্য বিভাগের নামে এটিই
বোধহয় সর্বপ্রথম জমজমাট প্রযোজনা। আমরা তো সকলেই নতুন দিনের স্বপ্ন দেখি। আর তাই
বলতে চাই এভাবেই বড় হবে সবকিছু; আজ হয়তো ইউনিট হিসেবে আছে কিন্তু একদিন এটাই পূর্ণ
বিভাগ হবে। নাম ছড়িয়ে পড়বে দূর-দূরান্তে। সাধু, সাধু, সাধু। যাহোক্, মূল বিষয়ে
যাওয়ার আগে একটু সেমিনার বিষয়ক আলোচনা সেড়ে নেওয়া যাক্।
সেমিনারের মূল বিষয়বস্তু ছিল “Interpretation of Tagore’s Plays in Contemporary Times”। মূখ্য বক্তা ছিলেন
অধ্যাপক এইচ. এস. শিবপ্রকাশ, সেন্টার ফর আর্টস এণ্ড এস্থেটিক্স, জওহরলাল নেহেরু
বিশ্ববিদ্যালয়; আলোচক হিসেবে ছিলেন ড: সেঁজুতি রায় মূখার্জী, সহযোগী অধ্যাপক,
বিবেকানন্দ কলেজ; অংশুমান ভৌমিক, নাট্য সমালোচক, দ্য টেলিগ্রাফ; অধ্যাপক তারক
সেনগুপ্ত(অব:), রবীন্দ্র সঙ্গীত, নৃত্য ও নাট্য বিভাগ, বিশ্বভারতী; অধ্যাপক বিপ্লব লোহ চৌধুরী, গনযোগাযোগ বিভাগ,
বিশ্বভারতী এবং সঞ্চালনা করেছেন অধ্যাপক অভিজিৎ সেন, ইংরেজী বিভাগ, বিশ্বভারতী। সকলের কথা ধরে ধরে হয়তো এই
স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে পুরো আলোচনার একটি সারাংশ তুলে ধরা যেতে
পারে নাটক বিষয়ে নানান কথাবার্তার মাঝে মাঝে।
শিবপ্রকাশজী তার মূখ্য আলোচনায় অত্যন্ত
সুন্দরভাবে দেশের নাট্যচর্চার পুরো ভাগ জুড়ে বিদেশীয় সংস্কৃতির যে বাড়বাড়ন্ততা
চলছে – খুব স্পষ্টভাষায় দ্ব্যর্থকন্ঠে তা প্রকাশ করলেন। এই বিদেশীয় রীতি মিশ্রিত
নাট্যধারা যে শুধু আমাদের প্রতিদিনকার নাট্যচর্চায় বাসা বেঁধেছে তা নয়, বাসা
বেঁধেছে আমাদের নাট্য শিক্ষাক্রমের একেবারে মূলাভ্যন্তরেও। তিনি তার কথায় এখনকার
সময়ে প্রচুর অর্থব্যয়ে নির্মিত ডিজাইন সর্বস্ব নাট্যশৈলী থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করে
প্রকৃত মঞ্চশিল্পকে ফিরিয়ে আনার তাগিদ থেকে ‘Eurocentric
Tradition’-এর বিপরীতে নির্দিষ্টভাবে ‘Tagore Tradition’-এর কথা উল্ল্যেখ করেন। সেই সাথে এই সময়ের নাট্য নির্দেশকদের আরও একবার স্মরণ
করিয়ে দেন রবিঠাকুরের ‘চিত্তপট’ আর ‘চিত্রপট’–এর ধারণার কথা। স্মরণ করিয়ে দেন
গুরুদেবের নাটক সম্পর্কে ভারতীয় নাট্য সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তি গিরিশ কার্ণাডের
ঘৃণিত আস্ফালন। অন্য একটি প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বি ভি করন্হ-এর সূত্র ধরে তিনি
বলেন “There is no ‘Contemporary Theatre’, only ‘Present Theatre’; Contemporary বলে কিছু হয়না, যদি হতো তাহলে গিরিশ
কার্নাডের চেয়ে রবীন্দ্রনাথ কেন এতো Contemporary, কিন্তু Tagore
তো নেই তাহলে Contemporary হয় কি করে”।
এরপর অধ্যাপক অভিজিৎ সেন তার আলোচনায় এনেছেন কেন রবীন্দ্রনাথ Marginalized; সত্যিই কি নির্দেশক বা নাট্যচর্চারত মানুষরা তাঁর
নাটকের প্রকৃত ধারণা বা দর্শন বুঝতে সক্ষম বা আদৌ বুঝে চর্চা করছেন? একেবারে শেষ
বক্তা হিসেবে অংশুমান বাবু গোটাকতক ছবি দেখালেন নানা প্রদেশের বা দেশের নানান
ভাষায় রবীন্দ্রনাথের মঞ্চ উপস্হাপন। নি:সন্দেহে এটি একটি প্রশংসনীয় বৃহদাকার
সংগ্রহ। কিন্তু শুধু স্হিরচিত্র তো কোনো নাটকের interpretation হতে পারে না যেটা সেমিনারের মূল বক্তব্য। উনি তো বিশ্বের কবি, সকলের, তাই
সকলেই তাঁর নাটক নিয়ে কাজ করবে এটাইতো স্বাভাবিক। আর এখানকার মানুষজন তো দিনরাত
রবীন্দ্রনাথেই মেতে আছে। বরঞ্চ অভিজিৎ দার কথার সূত্র ধরে বলতে হয় যে, সত্যিই কি এই
প্রযোজনাগুলোর কুশীলবরা রবীন্দ্রনাথের দর্শনটাকে বুঝে প্রযোজনা তৈরী করছেন? কারণ রবীন্দ্র
নাট্যের ক্ষেত্রে তো দর্শন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু রবীন্দ্রনাথের নাটকেই
কেন, অন্য যেকোনো নাটকের ক্ষেত্রেও তো দর্শন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়;
তাহলে সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নাটককে কি আলাদা করে দেখবার কোনো অবকাশ নেই? আমরা
শুধু এই প্রশ্নটা করতে পারি, উত্তর দেবার দায় আপনাদের যারা রবীন্দ্রনাথের
নাট্যচর্চায় রত। আর রবীন্দ্রনাথের নাট্যের উপস্হাপন বুঝতে গেলে তো বাংলা নাট্যের
সারৎসার সকলকে গুলে খেতে হবে নইলে উদ্ধার হওয়া যাবে না। যাহোক্, পরবর্তীতে অংশুমান
বাবুর অন্য কোনো উপস্হাপন থেকে বিস্তারিতভাবে নিশ্চয়ই শুনব সেই সকল প্রযোজনার সারকথা।
এবার আসি রাজার মঞ্চায়ন প্রসঙ্গে। এককথায় যাকে বলে ঝাঁ চকচকে প্রযোজনা।
তবে শিবপ্রকাশ জীর ভাষায় বলতে গেলে হয়তো বলতে হয় ডিজাইন সর্বস্ব নাটক। মাস ব্যাপি
কর্মশালায় নাট্যের এবং অভিনয়ের উভয়ক্ষেত্রেই যেরূপ Skill তৈরী হওয়ার কথা ছিল সেই না হওয়াটাই যেন ঢাকা পড়েছে ডিজাইনের চাপে। সেটের
আধিক্যতা খুব বেশী না হলেও একেবারে বাহুল্যতা বর্জিত নয়। তবে বেশ সুন্দর,
মনোগ্রাহী এবং দুর্দান্ত এটুকু তো বলাই যায়। প্রথম দর্শনেই মনে হবে আমরা কোলকাতার
বড় কোনো হলে বসে নাটক দেখছি। শুরুতে হঠাৎ করেই যখন মঞ্চের পেছনের দিকে এপাশ থেকে
ওপাশ জুড়ে পুরো মঞ্চ উচ্চতার একটি বিরাটাকায় প্রাসাদ কক্ষের (অনুমিত) দেয়াল চোখে
পড়ল – সাথে সাথে মনে পড়ে গেল ব্রিটিশ নির্দেশক টিম চ্যাপেলের এ মিড সামার নাইটস
ড্রিমের কথা। অস্বীকার করার উপায় নেই, একবার মনে হয়েছিল রাজা আবার এটা ছিড়েফুঁড়ে বেরিয়ে
আসবে না তো। তেমন কিছু হয়নি যদিও। সেটের সাথে রাজার কষ্টিউমের রং মিশে গিয়ে এক
অদ্ভুত illusion তৈরী করে মঞ্চে। খুবই সুন্দর ভাবনা
মনে হয়েছে নি:সন্দেহে। তবে আলোর সাথে মিশে সেটের রংটা দেখে কোথাও একটা মনে হয়েছে
যেন রেজিমেন্টেশের গন্ধ মিশে আছে। যদিও রাজা নাটকে কোথাও রেজিমেন্টেশনের
ব্যাপার আছে কিনা জানা নেই। তবে একটু বাড়িয়ে বললে হয়তো বলা যায় যে, মনের
রেজিমেন্টেশন ভাঙ্গার একটি সুর কোথাও লুকিয়ে থাকলেও থাকতে পারে। তবে রবীন্দ্র
নাটকে সেটের এই বিশালতা সত্যিই ভাবনার উদ্রেগ ঘটায়। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘রঙ্গমঞ্চ’
(১৯০৪) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন –
বিলাতের নকলে আমরা যে থিয়েটার করিয়াছি তাহা ভারাক্রান্ত একটা স্ফীত পদার্থ। তাহাকে নড়ানো শক্ত, ...তাহাতে কবি ও গুণীর প্রতিভার চেয়ে ধনীর মূলধন ঢের
বেশি থাকা চাই। দর্শক যদি বিলাতি
ছেলেমানুষিতে দীক্ষিত না হইয়া থাকে এবং অভিনেতার যদি নিজের প্রতি ও কাব্যের প্রতি যথার্থ বিশ্বাস থাকে, তবে অভিনয়ের
চারি দিক হইতে তাহার বহুমূল্য বাজে জঞ্জালগুলো ঝাঁট দিয়া ফেলিয়া তাহাকে মুক্তিদান ও গৌরবদান করিলেই সহৃদয় হিন্দুসন্তানের
মতো কাজ হয়।
এই প্রবন্ধের
পর শারদোৎসব (১৯০৮) কবির নুতন ধারার প্রথম নাট্যরচনা এবং তারপর তিনটি ছোটো নাটক
বাদ দিলে রাজা কবির এই ধারার দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ নাটক। সুতরাং তাঁর নাটকের মঞ্চ
সম্পর্কে উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গী মাথায় রাখলে তাঁর নাটক বুঝতে অনেক সহজতর হবে বলেই
বিশ্বাস।
ডিজাইনের অন্য কোনো অংশ সম্বন্ধে আলোচনা
না করলেও যেটা নিয়ে একটু কথা বলবার অবকাশ থেকে যায় তা হলো ‘আলোক পরিকল্পনা’। রাজা
নাটকে সত্যিকার অর্থেই আলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। Text-এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে আলোর খেলা। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে একজন দক্ষ
ডিজাইনারের চাতুরি। অন্য নাটকের ক্ষেত্রে শুধু ডিজাইন করে দিলেই হয়তোবা নাটক চলে
যায় কিন্তু এই নাটকে ডিজাইনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ন হলো মঞ্চে আলো ফেলা। আর এই
আলোর উপরেই ভর করে থাকে এই নাট্যকাহিনীর চলন এবং সেইসাথে এর দর্শনও। ডিজাইন নিয়ে
বিশেষ কিছু বলার নেই কারণ নির্দেশক তার প্রযোজনা যেভাবে দেখাতে চান - ডিজাইনারকে মোটের
উপর সেভাবেই পরিকল্পনা করতে হয়। তবে আলোক পরিকল্পনা বেশ ভালোই বলা যায় যেটা সেটের
সাথে একটা মেলবন্ধন তৈরী করেছে। তবে আলোক প্রক্ষেপণে তো নির্দেশক বা ডিজাইনারের
কোনো হাত থাকে না, সেটা যিনি নাটক চলাকালীন আলো পরিচালনা করছেন তার হাতে থাকে।
আলোর প্রক্ষেপণে পরিষ্কার বোঝা গেছে যে আলোর সাথে কোনোরূপ রিহার্সাল হয়নি। পুরো
নাটক জুড়েই দেখা গেছে আলোক প্রক্ষেপণের ত্রুটি বা অভিনেতার আলো নেওয়ার ত্রুটি। তবে
আলোর সাথে পর্যাপ্ত রিহার্সেল হলে খুব সহজেই এই ত্রুটি মুক্ত হওয়া সম্ভব বলেই মনে
হয়।
আমরা সবাই জানি, রবীন্দ্রনাথের নাটকে
গান এবং আবহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। নির্দেশককে ধন্যবাদ দিতেই হয় তিনি
শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত এবং বাদ্যযন্ত্রের পর্যাপ্ত রিসোর্স পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার
করতে পেরেছেন। পুরো নাটকের গানগুলো যারা গেয়েছেন বা বলা ভাল যারা লীড করেছেন তারা নি:সন্দেহে
নির্দেশকের সেরা পছন্দ বলতেই হয়। যেভাবে আবহ সঙ্গীত শিল্পীরা মঞ্চের বাঁদিকে ছড়িয়ে
বসেছিলেন মনে হচ্ছিল ইদানিংকালে কোলকাতার প্রেক্ষাগৃহের নাটকগুলোর মত হয়ত বিকট
কিছু শব্দযোগে আবৃত হবে। কিন্তু না, সুরের আবেশে তারা দর্শক মন ভরিয়ে
তুলেছেন।
যাহোক্, যেহেতু মঞ্চনাটক সেহেতু নির্দেশনা নিয়ে কিছু কথা তো বলতেই হয় তার উপর
আবার রবীন্দ্রনাথের রাজা। এ প্রসঙ্গে ‘নির্দেশকের কথা’ অংশের একেবারেই শুরুতে নির্দেশক
অবন্তী চক্রবর্তী বলছেন, “Tagore has tried to address the
spiritual balance between man and divine”। এখানেই মনে হয় সকল
গণ্ডগোলের শুরু। রাজা নাটকে রাজাকে রবীন্দ্রনাথ অন্তরালেই রেখেছেন। রেখেছেন
আভাসে, ইঙ্গিতে। বিশেষ করে রাজা নাটকে এই ইঙ্গিতটি বোঝা খুবই জরুরী। নির্দেশনা
প্রসঙ্গে আমাদের মতো ছা-পোষা মানুষদের বেশি কথা বলা বাতুলতাসম। শুধু এটুকুই বলা
যে, একটি রচনা মানে শুধু নাট্যকারের কতগুলো শব্দের সমষ্টি তো নয় বরঞ্চ বলা যায় সেটা
তাঁর সময় এবং তার রূপ, রস, গন্ধের একটি সম্মিলিত ইতিহাস। রাজা নাটকে রাজাকে
যদি দপ দপ করে মঞ্চে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায় তাহলে গিরিশ কার্ণাডের মত মানুষজন বলতে
পারেন না কি – “Tagore is the Second grade
Playwright”। তাতে দোষ কোথায়? রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর Text-এর কোথাও রাজাকে দেখা যায় বলে বলেন নি। আর অন্যভাষী হওয়ার
দরুণ তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ইংরেজীতেই রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন অথবা নানান
নির্দেশকের প্রযোজনা দেখেই শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথকে ‘Judge’ করছেন।
এটা কি ঠিক? এই প্রশ্নটা সকল রবীন্দ্র নাট্য নির্দেশক এবং গিরিশ কার্ণাডদের দল -
সকলের কাছেই থাকল।
যদিও রাজাকে মঞ্চে কীভাবে উপস্হাপন করবেন সেটা একান্তই নির্দেশকের নিজস্ব
ব্যাপার সেখানে আমাদের কথা বলার কোনো অধিকারই নেই। তবে নিতান্তই ছোটো বুদ্ধিতে শুধু
নাট্যকার এবং নির্দেশকের বোঝাপড়ার বিষয়ে এটুকুই বলা যেতে পারে যে, বিশেষ করে এই
নাটকটিতে রাজার কোনোরূপ অবয়ব যদি মঞ্চে প্রকাশিত হয় তাহলেই তার সুর যাবে কেটে। আমরা
জানি যে, একটি Play Text মানেই তার fluidity
আছে। আর আছে বলেই প্রযোজনা বিশেষে নির্দেশক থেকে নির্দেশকের ব্যাপক
তারতম্য ঘটে; কিন্তু অপরপক্ষে এই নাটকের ক্ষেত্রে এও তো সত্য যে, The image
of রাজা also fluid, static নয়। নির্দেশকের
মনের যে রাজা আর একজন সাধারণ দর্শকের মনের যে রাজা সে তো কখনও এক রাজা নয়, হতে
পারে না। আমরা শুধু একমূখী কোনো fluidity-তে তো চলতে পারিনা,
চলতে গেলে সমস্ত বিষয়টাকেই মাথায় রেখে চলতে হবে। But, at
the end of the day ‘Theatre’ is the Director’s medium। সেখানে
আমাদের কিছুই করণীয় নেই। তবে হ্যাঁ, কিছু একটা সমাধান তো অবশ্যই প্রয়োজন। তাই
সমাধানের খাতিরে বলা যায় যে, পুরো ব্রুসিয়ারের কোথাও রাজার মঞ্চায়িত এই Performanceটি রবীন্দ্রনাথের Play Text রাজা নাটকের
অনুসরণে বা অবলম্বনে হয়েছে কিনা বা হয়নি, সেরকম কিন্তু কিছু লেখা নেই। এই বিষয়েই
কোথাও কোনো অংশে কিছুমাত্র উল্ল্যেখ থাকলেও হয়তো আমাদের ভ্রম কিছুটা কাটতো। হয়তো
তারা বিশ্বাস করেন যে, তারা রবীন্দ্রনাথের Play Text কেই মঞ্চে এনেছেন। সেটা মনে হতেই পারে। তাতে দোষের কিছু নেই। তবে নাট্য
বিভাগের কাছে শুধু এটুকুই অনুরোধ তারা যেন একবার বিষয়টা ভেবে দেখেন। তাহলেও হয়তো রবীন্দ্রনাথের
Play Text-এর বিষয়বস্তু সংক্রান্ত কোনো তথ্য ভুলভাবে পৌঁছাবে
না; সেক্ষেত্রে Performance Text টা যেমনই হোক না কেন তাতে
হয়তো কারোর কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
সকালের সেমিনারে সেঁজুতি রায় মূখার্জী একটি
আফসোসের কথা বললেন যে, এখন কোলকাতায় রবীন্দ্রনাথের নাটক প্রায় হয়না বললেই চলে। দিদিকে
বলব – ‘দিদি, Thank God’। ভাগ্যিস হচ্ছে না।
কি যে হত তাহলে কে জানে। এই তো কয়দিন আগে শান্তিনিকেতনে সেইরকম একজন নির্দেশকের রক্তকরবী
দেখা হলো..., বাপ্রে। রবীন্দ্রনাথের interpretation বা reinterpretation সবটাই সাদরে গ্রহণযোগ্য কিন্তু
তাঁর মূলগত দর্শনকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই হয়তো নয়। এইতো কয়েকদিন আগে অভিজিৎ দা (সেন)
তাসের দেশ মঞ্চে নিয়ে এলেন যেখানে তাসের দলের সকলের তাসের পোষাক থাকলেও
তাসের রাজাকে উনি কিন্তু মিলিটারী পোষাকে নিয়ে এসেছেন। কারণ রবীন্দ্রনাথ সেখানে হয়তো
একটা সিস্টেমের কথাই বলতে চেয়েছেন। এবার নির্দেশক সেই সিস্টেমটা কীভাবে interpreate
করবেন in present context সেটা একান্তই তার ব্যাপার। এখানেই
তো Text-এর fluidity যেখানে মূলগত
দর্শনের কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়েই নির্দেশক তার মূল কার্য সাধন করতে পারে। এ
প্রসঙ্গে কবির কথার সূত্র ধরে আবারও বলতে হয় -
...ভাবুকের চিত্তের মধ্যে রঙ্গমঞ্চ আছে, সে রঙ্গমঞ্চে
স্থানাভাব নাই। সেখানে জাদুকরের হাতে দৃশ্যপট আপনি রচিত হইতে থাকে। সেই মঞ্চ, সেই পটই নাট্যকারের
লক্ষ্যস্থল...
ডাকঘর নাটকে কানাইলাল জীর এবং রাজা নাটকে রতন জীর interpretation সেভাবেই ফুটে উঠেছে, সমালোচিতও হয়েছে কিন্তু
তারা কখনই মূলগত দর্শন থেকে হয়তো বিচ্যুত হননি। তাদের দুইজনের কেউই কিন্তু
বাঙ্গালী নির্দেশক নন!
যাহোক্, সর্বশেষে একটু পরনিন্দা করেই বলতে হয়, নাট্য সমালোচক অংশুমান বাবু
সকালের সেমিনারে প্রসঙ্গান্তরে বলছিলেন, রবীন্দ্র-উত্তর কালে নির্দেশকরা (বাঙ্গালী
এবং অবাঙ্গালী) রবীন্দ্র নাট্য প্রযোজনায় উৎসাহী হননি যার একটি কারণ “বিশ্বভারতী
কর্তৃক প্রচণ্ডভাবে রবীন্দ্র রচনার কপিরাইট সংরক্ষিত ছিল বলে”। বেশ, ভালো কথা।
মেনে নিতেই হবে, সত্যিই ছিল। কিন্তু এটাই বিশেষভাবে সকলকে বলার যে, বিশ্বভারতী তো
রবীন্দ্রনাথকে পড়তে বা চর্চা করতে কোনো বাঁধা দেয়নি কখনও। বরঞ্চ এখনকার চেয়ে
নামমাত্র মূল্যে সেসময় তাঁর রচনাবলী বিক্রয় হয়েছে বলেই আমরা জানি। তাহলে আপামর
বাঙ্গালী নাট্যরসিকদের রবীন্দ্র নাট্যের মূলগত ‘দর্শন’ চর্চায় এত অনাগ্রহ কেন? নাট্যরসিকদের
কাছে এর উত্তর হয়তো থাকবে।
Comments
Post a Comment