প্রবন্ধ - ব্রিটিশ পরবর্তী স্বাধীন ভারতবর্ষে বাংলা নাট্যের ‘মূল স্রোত’ ও ‘বিপরীত স্রোত’: নাট্য-উপস্হাপনার তুলনামূলক পর্যালোচনা
**প্রবন্ধটি দুটো ভাগে পরপর দুটো সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে
প্রকাশ: 'Vabna Theatre' (ISSN 2321-5909)
প্রকাশকাল: জুলাই ২০১৫ এবং অগাষ্ট ২০১৫
Vol: 4 Issue: 12 (pp. 2-3)
Vol: 5 Issue: 1 (pp. 2-3)
সম্পাদনা: অভীক ভট্টাচার্য
সম্পাদনা: অভীক ভট্টাচার্য
ব্রিটিশ পরবর্তী স্বাধীন ভারতবর্ষে বাংলা নাট্যের ‘মূল স্রোত’ ও ‘বিপরীত স্রোত’: নাট্য-উপস্হাপনার তুলনামূলক পর্যালোচনা
বিভাস বিষ্ণু চৌধুরী
বিভাস বিষ্ণু চৌধুরী
প্রবন্ধটির মূল আলোচ্য বিষয় বাংলা নাট্যশিল্পের দুটি
সমান্তরাল ধারার চরিত্র উপস্হাপন রীতির
গঠনপার্থক্য ও সংস্কৃতিগত বৈসাদৃশ্যতার একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা। যেহেতু বাংলা নাট্যই প্রবন্ধের
মূল বিষয় তাই ক্ষেত্র হিসাবে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলার (ভারতের একটি প্রদেশ)
সমসাময়িককালের নাট্যপরিবেশনারীতিই হবে এই আলোচ্য বিষয়ের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলা নাট্যের উদ্ভবকাল
নিম্নোক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবে উঠে আসতে পারে তা হলো বাংলা নাট্যের উদ্ভবকাল ও
তার উপস্হাপনপদ্ধতি। তারও আগে আলোচনার স্বার্থে
যে বিষয়টির সমাধান সর্বাগ্রে প্রয়োজন তা হলো, ‘বাংলা নাট্য’ বলতে আসলে আমরা কোন্
নাট্য আঙ্গিককে বুঝি। খুব সহজ ভাষায় বল্লে বলা যায়, বাংলা সংস্কৃতির নিজস্ব
ঐতিহ্যের আদর্শে রচিত কোনো নাটলিপির১ দেশীয় ঐতিহ্যগত বা প্রথাগত
নাট্যবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কোনোরূপ নাট্য পরিবেশনারীতিতে পরিবেশিত যে কোনো নাট্য২কেই
আমরা ‘বাংলা নাট্য’ বলে আখ্যায়িত করতে পারি। তাহলে শুরুতেই এই নাট্যরীতির উদ্ভব
সম্পর্কিত একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে। বস্তুতপক্ষে এই নাট্যরীতির সৃষ্টিকাল সম্পর্কিত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের
কাছে নেই আর তাছাড়া কোনো শিল্পরীতির নির্দিষ্ট কোনো জন্মতারিখ গননা করা তো সম্ভব
নয়; এটি একটি স্বতস্ফূর্ত বিষয় যা কালের প্রয়োজনে আপনা আপনি সৃষ্টি হয়। এই নাট্যরীতি
সম্পর্কিত আলোচনা আমরা ভরতকৃত নাট্যশাস্ত্রে প্রথম দেখতে পাই। নাট্যশাস্ত্রে দেশ-বেশ-ভাষা ও রীতি অনুসারে চার ধরনের প্রবৃত্তির উল্লেখ পাওয়া যায় – অবন্তী, দাক্ষিণাত্য, ওড্র-মাগধী ও
পাঞ্চালী। তন্মধ্যে ‘ওড্র-মাগধী’৩ প্রবৃত্তি দ্বারা পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতকে বোঝায় – যার মধ্যে আমাদের
‘বঙ্গ’ও রয়েছে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, “কালের দিক থেকে বিচার করে বলা যায়, ‘ওড্র-মাগধী’ রীতি ভরত
ও তৎপূর্বকালেও ছিল। নাট্যশাস্ত্রের ‘প্রচলিত রূপটি’র নিম্নতর সীমারেখা
অষ্টম শতকের শেষভাগ বলেই অনুমিত হয়েছে। সুতরাং প্রাচীন বাঙলার নিজস্ব নাট্যরীতির
অস্তিত্ব অষ্টম শতকের পূর্বেও বিদ্যমান ছিল, একথা বলাই যায়।” (সেলিম আল দীন ২) আর নাট্যশাস্ত্র
যেহেতু আর্য সংস্কৃতির একটি শিল্পরূপ এবং তার পূর্বেও যেহেতু বাংলা নাট্যরীতির
অস্তিত্ব নাট্যশাস্ত্র সূত্রেই প্রমাণিত তাই ধারণা করা যায় যে, “...প্রাচীনকালে
দ্রাবিড়দের শিব বিষয়ক উৎসব ও কৃত্যের ধারা[তেই] এই নাট্যের
উদ্ভব ঘটেছিল।” (সেলিম আল দীন ১৪)
বাংলা নাট্যের
উপস্হাপন রীতি
এই নাট্যরীতির উপস্হাপনশৈলীও
নানাভাবে সম্পন্ন হতে
দেখা যায় যার মূল
ভাগে রয়েছে ‘কথানাট্য’ ও ‘নাটগীত’ এবং পরবর্তীতে এই
‘নাটগীত’ রীতিরই প্রধান শাখা হিসেবে বিবেচ্য ‘যাত্রা’। ‘কথানাট্য’ নাট্যরীতিতে “একজন মাত্র গায়েন অথবা কথক গদ্যে,
পদ্য-ছন্দে অথবা গীতের মাধ্যমে কোন কাহিনী পরিবেশন করেন। কখনো তাঁর হাতে থাকে একটি
চামর এবং পায়ে ঘুঙুর” (সৈয়দ জামিল আহমেদ ৯)। আজও দুই
বাংলার গ্রামীণ জীবনে ‘কথানাট্য’ রীতির যে কয়টি নাট্যশৈলী বিদ্যমান তন্মধ্যে
উল্ল্যেখযোগ্য হলো – নাম কীর্তন, পদাবলী কীর্তন, মঙ্গলচণ্ডীর গান, বিষহরির গান,
রয়ানী, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, গাজীর গান, মাদার পীরের গান, মানিক পীরের গান, জারী
গান, এবং পালা গান (প্রধানত ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ অবলম্বনে রচিত) প্রভৃতি। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের
পল্লীঅঞ্চলে ‘কথানাট্য’ রীতিতে উপস্হাপিত যেসকল ‘ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্য’ রীতি আমরা দেখতে পাই সেখানে
গায়েনের হাতে চামর হয়তো শোভা পায়না কিন্তু তার বদলে সে বালিশ অথবা লাঠি বা কখনো
গলার উড়নি ব্যবহার দ্বারা বর্ণিত চরিত্রকে নানাভাবে জীবন্ত করে তোলে। এই
নাট্যরীতিতে বা বলা যায় ‘ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্য’ রীতির সমুদয় উপস্হাপনশৈলীতেই ‘অভিনেতা’
বলে আলাদা করে কিছু দেখতে পাওয়া যায় না মূলত গায়েনই কখনো গদ্যে অথবা গীত এবং নৃত্য
দ্বারা কাহিনীবর্ণিত চরিত্র উপস্হাপনে ব্রতী হন যেখানে চরিত্রসমূহকে তিনি এক ধরনের
বর্ণনামূলক অভিনয় দ্বারা পরিবেশন করে থাকেন। আমরা
দেখতে পাই, আজকের ‘আধুনিক বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্যে’ (প্রধানত বাংলাদেশে) একটু আলাদা ভাবে বিষয়টিকে পরিবেশন
করা হয়ে থাকে, সেখানে দেখা যায় একজন গায়েনই কেবল সকল চরিত্র উপস্হাপন করছে না বরঞ্চ
বলা যেতে পারে মঞ্চাপোবিষ্ট সকল কুশীলবই এক একজন গায়েন
হয়ে উঠছে এবং পূর্বানুরূপ তারা কথা, গীত ও নৃত্যের মাধ্যমে বর্ণনামূলক অভিনয়
দ্বারা নাটলিপি বর্ণিত সকল চরিত্র উপস্হাপন করছে যা অনেকটা আমাদের মধ্যযুগের ‘নাটগীত’ রীতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ‘নাটগীত’
রীতির পরিবেশনায় আমরা দেখতে পাই ‘কথানাট্য’ রীতির প্রায় অনুরূপভাবে নৃত্য প্রযুক্ত হয়ে একাধিক কুশীলব কাহিনী বর্ণিত
চরিত্রসমূহকে উপস্হাপন করে। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ জামিল আহমেদ-এর কথার সূত্রে ধারণা করা যায় যে, এই ‘নাটগীত’ রীতিটি তথা মধ্যযুগের সমস্ত অভিনয়কলাই কবি জয়দেব কর্তৃক
ত্রি-চরিত্র বিশিষ্ট ‘গীতগোবিন্দে’র সাঙ্গীতিক আদর্শে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। বর্তমানে দুই বাংলার (বাংলাদেশ
ও পশ্চিমবঙ্গ) গ্রামীণ জনপদে ‘নাটগীত’ রীতির যে কয়টি নাট্যশৈলী বিদ্যমান রয়েছে
তন্মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলো – ভাসানযাত্রা, নেটো, গম্ভীরা, আলকাপ প্রভৃতি।
আলোচ্য অংশে ‘আধুনিক বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্য’ বলতে যা
বোঝাচ্ছে তা হলো – আমাদের ‘মধ্যযুগের বাংলা নাট্য’ এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ও
পশ্চিমবঙ্গের প্রধানত পল্লী অঞ্চলে প্রচলিত নানান রকম ‘ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যে’র
একটি পরিশিলীত আধুনিক রূপ। এই ‘আধুনিক
বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্য’ রীতিতে রচিত নাটলিপির আজকের যে রূপ আমরা দেখতে পাই তার
ক্রমবিকাশে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত যিনি একমাত্র ব্যতিক্রমী
ভূমিকায় নিজের রচনা দ্বারা বাংলা নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন তিনি হলেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (শারদোৎসব ১৯০৮, রাজা ১৯১০, ফাল্গুনী ১৯১৫,
রক্তকরবী ১৯২৪, তপতী ১৯২৯) এবং পরবর্তীতে (১৯৭১ পরবর্তী) স্বাধীন
বাংলাদেশে যিনি রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক এই অনুসরণীয় পথে অবতীর্ণ হয়ে বন্দনা, গীত,
বর্ণনাময় সংলাপ মুখর দেশীয় ঐতিহ্যবাহী নাট্যের বৈশিষ্ট্যসমূহকে বাংলা নাট্যের
নাটলিপিতে সন্নিবেশিত করে একটি আধুনিক রূপ দান করেন যাকে বর্তমান ‘আধুনিক
বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্য’ বলে আখ্যায়িত করা হয় তিনি সেলিম আল দীন (কেরামতমঙ্গল
১৯৮৫, হাত হদাই ১৯৮৯, চাকা ১৯৯১, যৈবতী কন্যার মন ১৯৯৫, বনপাংশুল
১৯৯৮, প্রাচ্য ২০০০ প্রভৃতি)।
ঔপনিবেশিকতা ও মধ্যখণ্ডন (১৭৯৪ থেকে ১৯৭১)
এই পর্যায়ে একটি বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টিপাত করা উচিৎ আর তা হলো, বিশ শতকের বাংলায় (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) কিছু
ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলা নাট্যের সকল সমালোচক, নির্দেশক, অভিনেতা সকলেই আঠার শতকের
শেষভাগে ১৭৯৪ সালে রুশদেশীয় অভিনেতা-নির্দেশক গেরাসিম
স্তেপানোভিচ্ লেবেদেফের থেকেই বাংলা নাট্যের উদ্ভবকালকে নির্দেশ করেছেন। এটা যে কোনোভাবেই সত্য নয় তার প্রমাণ আমরা একটু আগেই
পেয়েছি। ‘বাংলা নাট্যে’র খণ্ডিত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তারা ‘বাংলা
নাট্য’ বলতে তাকেই বোঝাচ্ছেন যাকে এই প্রবন্ধে ‘বিদেশী রীতির বাংলা নাট্য’ হিসাবে
আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাহলে দেখা যাক্ ব্রিটিশ উপনিবেশ সময় থেকে কীভাবে ‘বিদেশী
রীতির বাংলা নাট্যে’র এই ধারাটি আস্তে আস্তে ভারতীয় তথা বাংলা নাট্যশিল্পের
মূলস্রোত হিসাবে রূপ নিচ্ছে।
শিল্পের এমন
কোনো ক্ষেত্র নেই সে চিত্রকলা, স্হাপত্যকলা, নৃত্যকলা, সঙ্গীত সে যে মাধ্যমেই হোক্ - যেখানে ভারতীয় শিল্পাদর্শ মার্গীয় রূপ লাভ করেনি। সেইসাথে
প্রথাগত শিল্পও একইরকম উৎকর্ষতায় পৌঁচেছে। আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্যে বৃটিশরা দাঁত বসাতে
পারেনি ঠিকই, তার মানে এই নয় যে তারা তা চায়নি, কিন্তু তাদের সে ক্ষমতা ছিলনা।
কিন্তু খুব সহজেই তারা আমাদের নাট্যশৈলীর (ধ্রুপদী ও প্রথাগত) পুরো অবয়বটাকে সরিয়ে
রেখে তার মধ্যে তাদের নাট্যরীতিকে (উপস্হাপন
রীতি, দৃশ্যকলা, মঞ্চস্হাপত্য, সমুদয় ক্ষেত্রে) স্হাপন করে দেয় এবং ক্রমে যার গল্পটা ভারতীয়ই থাকে কিন্তু উপস্হাপন প্রণালীটা হয়ে যায়
ইউরোপীয়। অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ-এর ভাষ্যমতে বাংলা
ভাষায় রচিত নাটলিপির অংশ হিসেবে ১৮৫৯ সালে মধুসূদনের হাতেই সর্বপ্রথম ইউরোপীয়
নাট্যরচনা রীতির এই আত্মীকরণ সুসম্পন্ন হয়। তার মতে, “নাটকের অভ্যন্তরীণ
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে নাটকীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সচেতন
ব্যবহার এই প্রথম পঞ্চাঙ্কবিশিষ্ট নাট্যকাঠামোর অঙ্গীভূত হয়” (৪০)।
দেশীয় শিক্ষা,
অর্থনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি সকল স্তরে ইউরোপীয় ভাবধারার প্রত্যক্ষ প্রভাব তৎকালীন
ব্রিটিশ ভারতের জনমানসে ‘ঔপনিবেশিক মানস-বৈকল্য’তা সৃষ্টি করে যার ফলস্বরূপ দেখা যায় “বাংলার আবহমানকালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি সুসমন্বিত
একক অবস্হাকে বিচ্ছিন্ন করে ‘গ্রামীণ ও শহুরে’ – এই দুই পৃথক পথে চালিত করে। শহুরে অভিজাত
শ্রেণী, যারা সংখ্যালঘু কিন্তু অর্থনৈতিক শক্তির নিয়ন্ত্রক, তারা নিজেদের
নগর-সংস্কৃতিকে ইউরোপীয় ধাঁচে সাজাতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর উৎসাহ-উদ্দীপনা
ও কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেও এবং তা নতুন দিকনির্দেশে সক্ষম হলেও অধিকাংশ
ক্ষেত্রে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ও তাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে এটি সংযোগ
হারিয়ে ফেলে” (সৈয়দ জামিল আহমেদ ৩৫-৩৬)। বলা
যায়, সংস্কৃতির এই দ্বৈত স্বত্ত্বার (গ্রাম ও শহর) মধ্যে এই শহর কেন্দ্রিক জনগোষ্ঠী যারা
ইউরোপীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক – মূলত তাদের আনুকুল্যেই এই ইউরোপীয় নাট্যরীতিটি
মূলস্রোতে প্রবাহিত হতে আরম্ভ করে। তবে ৪৭-এর দেশভাগের পূর্ব পর্যন্ত এই
নাট্যধারাটি প্রধানত কোলকাতা কেন্দ্রিকই ছিলো এবং সরাসরি মূল স্রোতে প্রবাহিত না
হতে পারার একটা কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে তা হলো সেই সময়ের সমগ্র বাংলার
গ্রামগুলোর সাথে কোলকাতা শহরের যোগাযোগের অপ্রতুলতা। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী
আন্দোলনের সময় প্রয়োজনের তাগিদেই ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে’র রাজনৈতিক বিপ্লবের সাথে
সংস্কৃতির মিলনে যে বিপ্লব সংঘটিত হয় তার ফলে ইউরোপ প্রভাবিত তথাকথিত এই ‘বাংলা
নাট্য’ রীতি কিছুটা হলেও কোলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী মফস্বল এবং ক্রমে তা বাংলার
গ্রামীণ জীবনে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে।
যদিও এই সময়কালীন কোলকাতা শহরে ‘নাটগীত’ রীতিতে নাট্য
প্রযোজনার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৩৫ সালে নবীন চন্দ্র বসুর বাড়ীতে প্রথম অভিনীত বাংলা নাটলিপি
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল নাটলিপির অন্তর্গত বিদ্যাসুন্দর পালার
সংস্করণকৃত বিদ্যাসুন্দর-এর মঞ্চায়ন হতে। স্বভাবতই তার উপস্হাপন রীতিটি
একান্তভাবেই ইউরোপীয় কায়দায় মঞ্চায়িত হয়েছিল যদিও তাতে দেশীয় নাট্য উপস্হাপন
রীতিরও কিছুটা আভাস ছিল। মূলত এটি সেই সময়ের কিছু সৌখিন শহুরে নাট্যপ্রেমীদের হঠাৎ করে দেশীয় হয়ে উঠবার একটি প্রয়াস বলেই
মনে হয়। একে একটি নিরীক্ষামূলক প্রয়াস
বলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না কারণ এর প্রযোজনা ব্যয়ের সমুদয় অর্থের পরিমাণ ছিল দু’লক্ষ
টাকা যেটা সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই নগন্য নয়।
৪৭-এর দেশভাগের পর পশ্চিমবাংলার আর্থ সামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথে
জীবন জীবিকারও পরিবর্তন ঘটতে থাকে আর সেই সাথে খুব দ্রুত বাড়তে থাকে গ্রামের সাথে শহরের
যোগাযোগ। শিল্প সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে
বিদেশী ভাবধারার প্রভাব ও নিতান্ত অবহেলায় মধ্যযুগের ‘নাটগীত’ রীতির প্রধান শাখা হিসেবে বেঁচে থাকা ‘যাত্রা’ শিল্পেরও অনেক দৈন্যদশা শুরু হয়। নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদেই হোক বা দর্শক আকৃষ্ট করার
জন্যে – যে কারণেই হোক তা অনেক চটুল গান,
নাচ ও খিস্তি-খেউড় নির্ভর হয়ে পড়ে। সেই এক প্রান্তে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম, মফস্বল সর্বত্র এই ‘বিদেশী রীতিতে
বাংলা নাট্যে’র অনুপ্রেরণায় নাটলিপি রচনা ও পরিবেশনা
বিস্তরভাবে প্রাধান্য লাভ করতে থাকে যা আস্তে আস্তে ‘মূল
স্রোতে’ পরিণতি লাভ করে।
এই ক্ষেত্রে
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটটা একটু ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমানে পাকিস্তান) সরকার কর্তৃক
পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) সামরিক শাসন এবং
ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ে নাট্য রচনা এবং
পরিবেশনা একরকম বন্ধই ছিলো বলা চলে কিন্তু গ্রাম এবং মফস্বলের বিভিন্ন
লোকায়ত আচার অনুষ্ঠান যাকে আমরা বর্তমানে ‘ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্য’ বলে আখ্যায়িত
করে থাকি, সেগুলো কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে মূলত ধর্মীয় তাগিদেই। উদাহরণ
হিসেবে বলা যেতে পারে গাজীর গান, মাদার পীরের গান, মানিক পীরের
গান, জারীগান জাতীয় নানা ধরনের ‘কথানাট্য’ রীতির পুঁথি সাহিত্য মুসলিম
সম্প্রদায়ের কৃত্যরূপে উপস্হাপিত হয়েছে প্রধানত তাদের ধর্মীয় “ঐতিহ্যবাহী মুসলিম
বীর, আধ্যাত্মিক সাধক, মহানবী ও তাঁর পরিবারবর্গের জীবনকাহিনী অবলম্বনে” (সৈয়দ জামিল
আহমেদ ১৪)। অন্যদিকে মঙ্গলকাব্যের গান, মঙ্গলচণ্ডীর গান, বিষহরার গান,
রয়াণী, চণ্ডীযাত্রা, ভাসানযাত্রা নামক মঙ্গলকাব্য ভিত্তিক ‘কথানাট্য’ রীতির নানান
পরিবেশনা গ্রামীণ হিন্দু সমাজে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর পুজ্যরূপেই পরিবেশিত
হয়েছে। বাংলাদেশে এই ‘বিদেশী রীতির বাংলা
নাট্যে’র চর্চা শুরু হয় মূলত ১৯৭১-এ দেশ
স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের সরাসরি অণুপ্রেরনায় এবং ভাষা ও ধর্ম কেন্দ্রিক মৌলবাদী পাকিস্তানী শক্তির দীর্ঘ ২৫ বছরের
(’৪৭-’৭১) অপশাসনের পতনের পর মাতৃভাষাপ্রিয় সাধারণ শহুরে বাংলাদেশী
নাট্যপ্রেমিকেরা খুব সহজেই কোলকাতার সংস্কৃতিকে (এখানে মূলত নাট্যশিল্পের কথা বলা
হচ্ছে) বাঙ্গালী সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আপন করে নিতে শুরু করে যদিও এই পর্বটি
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই শুরু হয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু ভাষা ও
সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা তাই
স্বাধীনতাউত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের মানুষজন হঠাৎ করেই আবার এই বিদেশী রীতির
বঙ্গীয় নাট্যসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ সহজে মেনে নেবে না এটাই স্বাভাবিক আর তাই সেসময়ের
বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা ভাষার টানে, সংস্কৃতির টানে নিতান্তই বিচ্ছিন্নভাবে
অনুসন্ধান শুরু করে তাদের তথা বাঙ্গালীর নিজস্ব শিল্প সংস্কৃতির – ‘দেশীয় রীতির
বাংলা নাট্যে’র।
আলোচনার
দীর্ঘসূত্রতায় এই ‘বিদেশী রীতির বাংলা নাট্য’ এবং
‘দেশীয় রীতির বাংলা নাট্য’ – এই নাট্যশৈলী ২টি নিয়ে একটু পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। আলোচ্য প্রবন্ধে ‘বিদেশী
রীতির বাংলা নাট্য’ বলতে কোনো বিদেশী নাট্যকারের (বাংলা ভাষী নয়
এমন) রচিত কোনো নাটলিপির বাংলা অনুবাদ যার রচনাশৈলী ও উপস্হাপন পদ্ধতি বিদেশী অথবা এই দেশীয় নাট্যকারের (বাংলা ভাষী) বিদেশি
রীতিতে রচিত কোনো নাটলিপি যার উপস্হাপন শৈলীও বিদেশী – উভয় ক্ষেত্রের নাটলিপি এবং নাট্য উপস্হাপন শৈলীকেই বোঝানো হচ্ছে। আর ‘দেশীয়
রীতির বাংলা নাট্য’ আমরা তাকেই বলতে পারি যার নাটলিপি, নাট্যশরীর, উপস্হাপন পদ্ধতি ও অভিনয় স্হান একান্তভাবেই দেশীয় (বঙ্গীয়) রীতির প্রবাহতা
ধারণ করে।
মূল স্রোতের নাট্যধারা
এবারে ‘মূল স্রোতের
নাট্যধারা’ বলতে কি বোঝা যায় সেদিকে ফেরা যাক্।
‘মূলস্রোতের নাট্যধারা’কে বিশেষায়িত করতে খুব বেশী শব্দচর্চার প্রয়োজন পড়েনা; খুব
সহজেই বলা যায় যে,
তথাকথিত ইউরোপীয় ভাবধারায় প্রভাবিত নাট্যশৈলীর দ্বারা অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে (প্রসেনিয়াম অথবা এর সংশ্লিষ্ট যেকোনো ধরণের মঞ্চ) সীমিত সংখ্যক দর্শকের (প্রধাণত শহুরে) সামনে উপস্হাপিত যে
নাট্যধারা তাকেই আমরা প্রধানত ‘মূল স্রোতের নাট্যধারা’ বলে আখ্যায়িত করতে পারি। আলোচনার
সুবিধার্থে একে প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে :
১. শহর
কেন্দ্রিক প্রসেনিয়াম মঞ্চে ‘বিদেশী রীতিতে বাংলা নাট্যে’র মঞ্চায়ন
২. শহর
কেন্দ্রিক প্রসেনিয়াম মঞ্চে ‘দেশীয় রীতিতে বাংলা নাট্যে’র মঞ্চায়ন
উল্লেখ্য,
দুই ক্ষেত্রেই প্রসেনিয়াম মঞ্চের ব্যবহার রয়েছে। প্রথম ভাগের ক্ষেত্রে ‘বিদেশী রীতিতে
বাংলা নাট্যে’র মঞ্চায়ন নিয়ে অবশ্যই একটি আলোচনার ক্ষেত্র তৈরী করে। আর ২য় ভাগের ক্ষেত্রে ‘দেশীয় রীতির বাংলা
নাট্যে’র প্রসেনিয়াম মঞ্চায়নে মঞ্চ এবং দর্শক দুটো বিষয়েই আলোচনার প্রয়োজন।
শহর
কেন্দ্রিক প্রসেনিয়াম মঞ্চে বিদেশী রীতিতে বাংলা নাট্যের মঞ্চায়ন :
মূল স্রোতের
নাট্যধারায় এই ভাগটিই সবচেয়ে গুরুত্বসহকারে বিবেচ্য যেখানে বিদেশী ভাবধারায় তথাকথিত
ইউরোপীয় ভাবধারায় অণুপ্রাণিত বাংলা ভাষায় লিখিত কোনো নাটলিপি যখন কোনো বিদেশী রীতিতে প্রসেনিয়াম
মঞ্চে উপস্হাপিত হয়; যাকে কোনোভাবেই ‘বাংলা নাট্যে’র বিবেচনায়
উত্তীর্ণ করা যায় না। এক্ষেত্রে বাংলায়
অনুবাদকৃত অন্য যে কোনো ভাষার নাটলিপিগুলোও এই একই বিবেচনায় গৃহিত হবে।
এই
পর্যায়ের আলোচনায় শুধুমাত্র প্রসেনিয়াম মঞ্চের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি বা অনুযোগের
কোনো সুযোগ নেই। কারণ কোনো একটি বিশেষ সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের ধারায় একান্তই তাদের
নিজস্ব প্রয়োজনে তাদের রীতিতে রচিত নাটলিপি সমূহের দর্শক মনোগ্রাহী উপস্হাপনের
নিমিত্তে এইরকম একটি মঞ্চ উদ্ভুত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলা সংস্কৃতি সেই
সংস্কৃতির উত্তরাধিকার দাবী করে কিনা; যদি না করে তাহলে বাংলা সংস্কৃতির নিজস্ব
প্রয়োজনে তার নাটলিপিসমূহের দর্শক মনোগ্রাহী উপস্হাপনার নিমিত্তে তৈরী যে
মঞ্চস্হাপত্য আবহমান কাল ধরে বর্তমান – তার ব্যবহার না হয়ে যখন বাংলা নাট্যের
উপস্হাপন মাত্রেই প্রসেনিয়াম মঞ্চ ব্যবহৃত হয় সেক্ষেত্রে আলাদা রকম একটি পরিবেশনা
রীতি হয়তো তৈরী হয় কিন্তু বাংলার এই দুই ভূমিতে সমসাময়িক নাট্যচর্চায় এই বিদেশী
সংস্কৃতির লালনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু আছে সেটা বুঝতে ভ্রম হয়। ‘বাংলা নাট্যে’র
হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখতে পাওয়া যাবে এই অঞ্চলের মানুষের ধর্মীয়
ও সামাজিক রীতিনীতির প্রয়োজনীয়তা এবং সর্বোপরি দর্শক রুচির চাহিদা মেটাতেই এর
নাটলিপি ও তার উপস্হাপন পদ্ধতি এবং মঞ্চস্হাপত্য নির্মিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে
প্রসেনিয়াম মঞ্চে নাট্য উপস্হাপনার আলোচনা প্রসঙ্গে নাট্যতাত্ত্বিক Suresh Awasthi তার Performance
Tradition in India গ্রন্হে অবিভক্ত বাংলায় ‘প্রসেনিয়াম
থিয়েটারের’ সূত্রপাত প্রসঙ্গে খুবই অনবদ্য ও প্রাঞ্জল ভাষায় বলছেন,
The
first proscenium theatre was built in Calcutta in 1860, forcing frontal view
of the performance on the spectators. Thus
totally changed the aesthetic of reception of a theatrical
performance and also broke close and intimate relationship between the actors and spectators.
Indian audiences
had traditionally seen performances
often by moving from different
angles and levels, having
multiple perception of a performance. Sculpture on
the outer walls of the temples is also meant to be seen by making
parikrama (circumambulation)
because it is only then that the sculptures make
their full dramatic impact on the viewers (74).
প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথের কথার
সূত্র ধরে বলা যায় যে, বাঙালী দর্শকের কাছে ‘যাত্রা’ এজন্যই এতটা প্রিয় কারণ এর
অভিনয়ে দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে কোনো গুরুতর পার্থক্য নেই। দু’জনের পারস্পরিক
বিশ্বাস ও আনুকুল্যের উপর নির্ভর করেই এর নাট্যক্রিয়া সম্পাদন হয়। সুতরাং এ কথা
বলাই যায় যে, সংস্কৃতি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যেখানে জীবন, সময় ও তার আনুষঙ্গিক
নানান প্রয়োজনে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে এর ক্রমবিবর্তন ঘটে কিন্তু তার
মধ্যে আলাদাভাবে অন্য একটি সংস্কৃতির অযাচিত প্রবেশ কখনই সেই সংস্কৃতির নন্দনবোধকে
তার নিজস্ব নন্দনতত্ত্বের মধ্য দিয়ে উন্নত করতে পারে না। তার বিকৃতি ঘটেই। আর তাই,
বাংলা নাট্যের রূপ, গন্ধ, রস তখনই পরিপূর্ণরূপে প্রকাশিত হবে যখন তথাকথিত
প্রসেনিয়াম মঞ্চে প্রধানত শহুরে দর্শকের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলার নিজস্ব
মঞ্চশৈলীর প্রেক্ষিতে সৃষ্ট নাট্য উপস্হাপনাসমূহ সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ জনসাধারণের
মধ্যে বিস্তৃত হবে। আর যতদিন পর্যন্ত না এই প্রসেনিয়াম মঞ্চ বর্জন করা যাবে ততদিন
পর্যন্ত বাংলার গ্রামীণ ও শহুরে জনপদের নাট্যক্রিয়ার পারস্পরিক আদানপ্রদান
কোনোভাবেই সম্ভব হবে না এবং তার ফলে আজ বাংলার নিজস্ব নাট্যশিল্প যেটুকু বেঁচে আছে
কাল সেটাও গত হবে। তবে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া
প্রয়োজন, তা হলো, শুধুমাত্র প্রসেনিয়াম মঞ্চ বর্জন করে তিনদিক খোলা বা চতুর্দিক
খোলা মঞ্চে নাট্য উপস্হাপনা সম্পন্ন হলেই তা ‘বাংলা নাট্য’ বলে অভিহিত হতে পারে
না। তার জন্য প্রসেনিয়াম মঞ্চ বর্জনের পাশাপাশি বাংলার ‘ঐতিহ্যবাহী নাট্য আঙ্গিক’
আশ্রিত নাট্য উপস্হাপনাও একান্তভাবে জরুরী।
এবারে
এই ‘বিদেশী রীতির বাংলা নাট্য’র নাট্য উপস্হাপনা পদ্ধতির নানান প্রতিকূলতা এবং এই
দেশীয় সংস্কৃতির সাথে এর বৈসাদৃশ্যতা ‘দেশীয় রীতির বাংলা নাট্যে’র বর্ণনাত্মক
অভিনয় পদ্ধতির সাথে একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা দ্বারা তুলে ধরা যাক্। আমরা
পূর্বেই অবগত হয়েছি যে, ‘বিদেশী রীতির বাংলা নাট্যে’ অভিনেতার সাথে দর্শকের আপাত
কোনো সম্পর্ক নেই। এর চরিত্র উপস্হাপিত হয় প্রধানত ‘চরিত্রাভিনয় রীতি’তে যেখানে
শুধুমাত্র একজন অভিনেতার (চরিত্র) সাথে অপর একজন অভিনেতারই (চরিত্র) প্রত্যক্ষ
যোগাযোগ ঘটে এবং অভিনেতা তার প্রদেয় চরিত্রের স্বাত্ত্বিকতায় নিজেকে এমনভাবে
নিবিষ্ট করে যেন মঞ্চে তার বাস্তব জীবনের প্রতিফলন ঘটে। বিখ্যাত নাট্য
নির্দেশক স্তানিস্লাভস্কি তার ‘মেথড অভিনয়ে’ অভিনেতার এই বিশেষ অবস্হাকে ‘magic
if’ দিয়ে বোঝাচ্ছেন যেখানে চরিত্রের ‘যদি’ স্বত্ত্বাটি magically ‘যদি’ থেকে ‘বাস্তবে’
রূপ নেয়। চরিত্রের এই বাস্তব রূপ দানের নিমিত্তে নাটলিপি প্রদত্ত
চরিত্রের অবস্হা বিচারে তার সাজ-সজ্জা, পোষাকের বাস্তব রূপ দেওয়াও বাঞ্চনীয়।
এই সবটা মিলিয়ে অভিনেতা তার মানসপটে নিজের এবং চরিত্রের মাঝামাঝি একটি মানসিক স্তর
তৈরী করে যার মাধ্যমে দর্শকের কাছে নাটলিপি বর্ণিত চরিত্রের একদম বাস্তব রূপটি
প্রকাশিত হয়। কিন্তু ‘বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্যরীতি’তে এমনটি ঘটে না, এখানে গায়েনের
(অভিনেতা অর্থে) সাথে অপর গায়েনের যোগাযোগটাই স্হাপিত হয় দর্শকের মধ্য দিয়ে এবং
অদ্ভুতভাবে একজন গায়েন একইসাথে একাধিক চরিত্রের চরিত্রায়ন করেন কিছুমাত্র সময়ের
ব্যবধানে কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তাতে তার চরিত্রের স্বাত্ত্বিকতার কোনো
কার্পণ্যতা পরিলক্ষিত হয়না। ‘রামায়ণ গানে’ দেখা যায় গায়েন রামের ভূমিকায় অবতীর্ণ
হয়ে বীর রসের অভিনয় করলে দর্শক ‘রাম’ ‘রাম’ ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠছে আর তার একটু
পরেই সে আবার যখন সীতার ভূমিকায় অভিনয় করছে এবং বিনা ক্লেশে বীর রস থেকে বেরিয়ে
এসে করুণ রসের অভিনয় করছে এবং তাতে দর্শক নিশ্চুপভাবে চোখের জলে গায়েনের অভিনয়ে
সিক্ত হচ্ছে। ‘গায়েনে’র সাথের স্তানিস্লাভস্কির ‘অভিনেতা’র পার্থক্য হলো ‘গায়েন’
চরিত্রের স্বত্ত্বিকতায় উত্তীর্ণ হয় আত্মশুদ্ধি কল্পে চরিত্রের ভাব প্রকাশের মধ্য
দিয়ে আর স্তানিস্লাভস্কির ‘অভিনেতা’ চরিত্রের স্বত্ত্বিকতায় পৌঁছায় শুধুমাত্র
চরিত্র হয়ে উঠবার প্রয়োজনে। আমাদের দেশের জনমানসের মনে যে রঙ্গভাবনা রয়েছে তাতে
আলাদা করে কোনো চরিত্রের বাস্তবানুরূপ বেশ-ভূষা পরে চরিত্রায়নের চরম বাস্তব রূপে
প্রত্যক্ষ করানোর প্রয়োজন পড়েনা কারণ দর্শক চিত্তে যে রঙ্গমঞ্চ আছে তা সংকুচিত
নয়। “...সে রঙ্গমঞ্চে স্হানাভাব নেই।
সেখানে জাদুকরের হাতে দৃশ্যপট আপনিই রচিত হতে থাকে। সেই মঞ্চ, সেই পটই নাট্যকারের
লক্ষ্যস্হল” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭৬)।
এই ‘চরিত্রাভিনয় রীতি’র অভিনয়পদ্ধতিতে অভিনেতা তার প্রদেয় চরিত্রের সাথে নিজের যে আত্মিক সম্পর্ক তৈরী
করছেন, তাকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাসযোগ্য মঞ্চায়ন করতে গেলে নাট্যকার কল্পিত যে
দৃশ্যপট নাটলিপিতে বর্ণিত থাকে তার সুপুষ্ট বাস্তবানুরূপ উপস্হিতি মঞ্চে না থাকলে
এই রীতির অভিনেতা কখনই তার চরিত্রের বাস্তবতা নিয়ে দর্শক মনে পৌঁছাতে পারবে না।
যেমন, ইবসেনের A doll’s House – এর প্রসেনিয়াম মঞ্চায়ণে হেলমারের (নাটকের একটি চরিত্র) বাড়ীর ড্রয়িংরুম বোঝাতে আস্ত একটি
ড্রয়িংরুমকেই মঞ্চে আনতে হচ্ছে দৃশ্য, চরিত্র, আবহের বাস্তব রূপ দিতে অপরদিকে
‘বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্যে’র ‘পটগানে’র চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই,
সেখানে একজন গায়েন নাটলিপি বর্ণিত ‘ষড়ঋতু’র বর্ণনায় শুধুমাত্র সংগীত এবং
অঙ্গভঙ্গীর আশ্রয় নিচ্ছেন আর দৃশ্যপটের চাহিদা মেটাতে দু’জন দোহার কর্তৃক
নিয়ন্ত্রিত একটি কাপড়ে অঙ্কিত পটচিত্র তালের সাথে সাথে স্ক্রোলের মত করে
নিয়ন্ত্রিত হয়ে নাট্যকাহিনীকে বর্ণিত করছে। এক্ষেত্রে ‘ষড়ঋতু’র বর্ণনায় যদি
‘চরিত্রাভিনয় রীতি’র আশ্রয় নেওয়া হতো তাহলে দৃশ্যপটের জন্য হয়তো জীবন্ত গাছপালা,
গবাদি পশু তুলে আনতে হতো যার কোনোকিছুই গায়েনের তথা ‘বাংলা নাট্যে’র প্রয়োজন
পড়েনা। খুবই সাধারণভাবে তিনি একটি লাঠি সহযোগে পটচিত্রের উপর নির্দেশনা দিচ্ছেন
তার গান ও নৃত্য সহযোগে, তাতে দর্শক মনের রঙ্গপটে নিজের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দু:খ
মিশ্রিত যে ‘ষড়ঋতু’র ছবি আছে তাই তাদের কাছে সেই সময়ের জন্য জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “...য়ুরোপীয়ের বাস্তব সত্য নহিলে
নয়। কল্পনা যে কেবল তাহাদের চিত্তরঞ্জন করিবে তাহা নয়, কাল্পনিককে অবিকল বাস্তবিকের মতো করিয়া বালকের মতো
তাহাদিগকে ভুলাইবে” (৭৭)। আমাদের নাট্যশৈলী হেলমারের
ঘরের ড্রয়িংরুমের ছবির মত নয় যেখানে দৃশ্যপট এতটাই বাস্তব হয়ে উঠে যে দর্শকের
আলাদাভাবে চিত্তপট বিকাশের কোনো সুযোগ থাকে না। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর
‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে কালিদাসের শকুন্তলা নাটলিপির একটি অংশের উদাহরণ দিয়ে
বলছেন “....দুষ্যন্ত ও সারথি একই স্থানে
স্থির দাঁড়াইয়া বর্ণনা ও অভিনয়ের দ্বারা রথবেগের আলোচনা করেন, সেখানে দর্শক এই অতি সামান্য কথাটুকু অনায়াসেই ধরিয়া লন
যে, মঞ্চ ছোটো, কিন্তু কাব্য ছোটো নয়; — অতএব কাব্যের খাতিরে মঞ্চের এই অনিবার্য ত্রুটিকে প্রসন্নচিত্তে তাঁহারা
মার্জনা করেন এবং নিজের চিত্তক্ষেত্রকে সেই ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যে প্রসারিত করিয়া দিয়া
মঞ্চকেই মহীয়ান করিয়া তোলেন” (৭৬; emphasis
added)।
আজকের
প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে দুই বাংলাতেই (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) ‘বাংলা নাট্যে’র নিজস্ব রীতিটিকে একরকম পাশে সরিয়ে রেখে
বিদেশী রীতিতে নাট্য উপস্হাপন বা রচনা উভয়টিই আজকের ইউরোপে তাদের নাট্যরচনা ও
উপস্হাপনের সাথে তুলনামূলক বিচার করলে আমাদের
দ্বারা চর্চিত এই নাট্যশৈলীটি হাস্যকরভাবে প্রকাশিত হয়; যেখানে আমাদের নিজেদের নাটলিপি রচনা ও উপস্হাপনার অত্যন্ত সুদৃঢ় একটি
নাট্যঐতিহ্য হাজার বছর ধরে বর্তমান আছে সেখানে কেন হাস্যকরভাবে অন্যের সংস্কৃতির
এই নির্লজ্জ উপস্হাপন। চিরায়ত বাংলার নাট্য পরিবেশনার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক
দর্শক ও গায়েনের (অভিনেতা) সরাসরি যোগাযোগ - যার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
এই প্রসেনিয়াম মঞ্চ। আজকের ‘ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যে’র নানান ধরনের আনুষ্ঠানিক
মঞ্চে দর্শক ও অভিনেতার সরাসরি অংশগ্রহনে যদি বিদেশী রীতিতে রচিত বাংলা
নাটলিপিসমূহের উপস্হাপনা হতো তাহলেও হয়তো বা নতুন কোনো উপস্হাপন পদ্ধতির কথা ভাবা
যেতে পারত।
শহর
কেন্দ্রিক প্রসেনিয়াম মঞ্চে ‘দেশীয় রীতিতে বাংলা নাট্যে’র মঞ্চায়ন :
‘দেশীয়
রীতির বাংলা নাট্য’ সম্পর্কে পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে কোন্ উপস্হাপনাগুলোকে আমরা
‘দেশীয় রীতির বাংলা নাট্য’ বলব। এই অংশে যে বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে
লক্ষ্যণীয় তা হলো, আজকের বাংলাদেশে গত ৩০ বছরে যে কয়টি নাট্যদল ‘বাংলা নাট্যে’র হাজার বছরের নাট্য
ঐতিহ্যের অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট যে আধুনিক নাট্য আঙ্গিকের চর্চা করে আসছে তাদের মধ্যে খুব অল্প কিছু
ব্যতিক্রম ছাড়া বাকী সবটাই প্রসেনিয়ামকে আদর্শ ধরেই উপস্হাপিত হচ্ছে। উদাহারণ হিসেবে বলা যায়,
‘ঢাকা থিয়েটার’–এর এই সময়ের কালের প্রযোজনা নিমজ্জন, ধাবমান ‘আরশিনগর’-এর সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, ‘নাট্যম
রেপার্টরী’-এর দমের মাদার প্রভৃতি। দর্শকও
প্রধানত ঢাকা কেন্দ্রিক শহুরে দর্শক। মফস্বল শহরে কালে ভদ্রে তারা হয়তো প্রযোজনা
নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেখানেও প্রসেনিয়ামকে ঘিরেই নাট্য উপস্হাপন করতে হচ্ছে। ব্যতিক্রম যারা তারা প্রধানত ‘পরীক্ষণ হল’ ও ‘ষ্টুডিও থিয়েটার হলে’ তিনদিক
বা কোনো কোনো সময় চতুর্দিকে দর্শক রেখে নাট্য উপস্হাপন করছে কিন্তু সেই একইভাবে
দর্শক হিসাবে থাকছে শহুরে দর্শক প্রধানত ঢাকা শহর। যেমন ‘বটতলা’-এর খনা,
‘আরশিনগর’-এর সে রাতে পূর্ণিমা ছিলো প্রভৃতি নাট্য প্রযোজনাসমূহ। এর প্রধান
কারণ হিসাবে বলা যায় ঢাকা শহরে প্রসেনিয়ামের পাশাপাশি বাংলার নিজস্ব মঞ্চস্হাপত্যের
আদর্শে মঞ্চ নির্মান হলেও গ্রাম ও মফস্বল শহরগুলোতে এরকম মঞ্চস্হাপত্য নির্মানের
কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, মঞ্চ বলতে সেখানে যার অস্তিত্ব দেখতে পাই সেটা প্রসেনিয়াম
মঞ্চ। এই অবস্হা চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই এটি একপেশে শহুরে বাতাবরণে তার প্রাকৃত
রসবোধ বর্জিত হয়ে উঠবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ জনপদের সহিত সংযোগ হারিয়ে ফেলবে।
এক্ষেত্রে
পশ্চিমবঙ্গে এই রীতিতে নাট্যচর্চা প্রসঙ্গে খুবই অল্প কিছু নাট্যতাত্ত্বিকের
গবেষণা কর্ম ও প্রযোজনার কথা জানতে পারি। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে যার গবেষণা
কর্ম আমাদের নজরে আসে তিনি হলেন শাঁওলী মিত্র এবং এই রীতির প্রযোজনা হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের যে সকল
নাট্য প্রযোজনাসমূহ স্বীকৃতির দাবী রাখে সেগুলো হলো কথাঅমৃতসমান, নাথবতী
অনাথবৎ প্রভৃতি নাট্যপ্রযোজনা। আর এই সময় পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কোনো শহর অথবা
মফস্বলে বাংলা স্হাপত্যের আদর্শে কোনো মঞ্চ নির্মাণ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ‘দেশীয় রীতির
বাংলা নাট্যে’র এই নব নাট্য আঙ্গিককৃত মঞ্চায়ণসমূহ সারা বাংলায় ছড়িয়ে দিতে প্রতিটি
শহরে এর উপস্হাপনের উৎকৃষ্ট মঞ্চস্হাপত্য নির্মাণ করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে অবশ্যই
সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে তার কারণ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতিরেকে এই ধরনের উন্নয়ন
কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা এক অর্থে অসম্ভব।
এবার আসি
‘অনুবাদ নাট্য’ প্রসঙ্গে। কোনো বিদেশী রীতিতে বিদেশী ভাষায় রচিত কোনো নাটলিপির
বাংলা অনুবাদের দেশীয় (বঙ্গীয়) রীতিতে উপস্হাপনাকে আমাদের বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা
করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিদেশী নাট্যকারের লেখা কোনো নাটলিপি যদি দেশীয় রীতিতে তার নিজস্ব মঞ্চে পরিবেশিত হয়
তবে সেটি ‘দেশীয় রীতির বাংলা নাট্য’ বলেই বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তার কারন এইদেশীয়
রীতিতে কোনো বিদেশী নাটলিপির নাট্য উপস্হাপন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হলে অনুবাদের
পর সেই নাটলিপিটি দেশীয় রীতির নাটলিপির অনুরূপ রূপ প্রদান করতে হবে অন্যথায়
এইদেশীয় রীতিতে তার উপস্হাপন এক কথায় অসম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রেখট, ইবসেন
অথবা শেক্সপীয়রের কোনো নাটলিপি যদি এইদেশীয় রীতিতে দেশীয় মঞ্চে প্রযোজিত হয় তাহলে
অবশ্যই সেটি ‘দেশীয় রীতির বাংলা নাট্য’ বলেই বিবেচিত হওয়া উচিৎ। এ প্রসঙ্গ আলোচনায়
উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের অন্যতম নাট্যসংগঠন ‘ঢাকা থিয়েটারে’র উল্লেখ করা যায়।
‘ঢাকা থিয়েটার’ ২০১৩ সালে ‘শেক্সপীয়ারে’র দ্যা টেম্পেষ্ট নাটলিপিটির বাংলা
অনুবাদ এবং পরবর্তীতে অনুবাদ কর্মটি ‘বাংলা নাট্যে’র ধারায় রূপান্তর করে দেশীয়
নাট্য রীতিতে সেটি পরিবেশন করে যার মূল জায়গা জুড়ে ছিল মধ্যযুগের বাংলা ‘নাটগীত’
রীতি। পুরো উপস্হাপনাটিতে সকল কলাকুশলীই মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলো পুরো সময়, বাংলা
নাট্যে যাদেরকে ‘দোহার’ বলে উল্লেখ করা হয়। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, নাট্যের
দৃশ্যায়ন পরিকল্পনায় কবি কল্পনায় বর্ণিত দৃশ্যাবলীর বাস্তবানুরূপ কোনো সেটের
ব্যবহার হয়নি যা সর্বদাই ‘বাংলা নাট্যে’র একটি বর্জিত বিষয় বরঞ্চ পুরো মঞ্চের
পিছনে অত্যন্ত দক্ষহাতে নৌকার পাল অঙ্কিত শুধু একটিমাত্র পটচিত্র শোভা পাচ্ছিল যার
দ্বারা নাট্যকৃত ঘটনার একটি অপরূপ রূপ বর্ণিত হয়েছে। সংলাপ, গান, ও অভিনয়ের এই
বর্ণনাধর্মী উপস্হাপন শেক্সপীয়রের পঞ্চাঙ্ক রীতির নাট্যকাঠামোকে ভেঙ্গে
‘বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্য’ রীতির আদলে সুর, তাল ও লয়ের মিশ্রনে এক অপূর্ব আবহ তৈরী
করেছে। তবে উপস্হাপন পদ্ধতিটি দেশীয় হলেও একটি পর্যায় পর্যন্ত এটি বিদেশীই থেকে
যাচ্ছে কারণ তা উপস্হাপিত হচ্ছে এক দিক খোলা প্রসেনিয়াম মঞ্চে, লোকায়ত বাংলার তিনদিক বা চতুর্দিক খোলা
মঞ্চে নয়। তার দর্শকও প্রধানত শহুরে, গ্রামীন নয়; এক কথায় বলা যায় দেশীয় রীতিতে
নাট্যউপস্হাপন হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীন জনগোষ্ঠীর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
‘বাংলা নাট্যে’র এইরূপ গঠনগত বৈচিত্র্যময়তা শুধু আনলেই হবেনা সেই পরিবর্তিত
বৈচিত্র্যের আধুনিকায়নকে গ্রামীণ জীবনের দৈনন্দিন কর্মপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তা না হলে ভবিষ্যতে এগুলো শুধু আর্কাইভেই শোভা পাবে।
বিপরীত
স্রোতের নাট্যধারা
এবারে
‘বিপরীত স্রোতের নাট্যধারা’ আমরা কাকে বলব। ইংরেজী ‘alternative’ শব্দটির বাংলা আভিধানিক অর্থ ‘বিকল্প’ হলেও হাজার বছর ধরে বাহিত হয়ে আসা নিজ
সংস্কৃতির এই সুবৃহৎ নাট্যশৈলীকে ‘মূল স্রোতে’র বিপরীতে ‘বিকল্প’ বলতে কুন্ঠাবোধ
হয় তাই একে ‘বিপরীত স্রোতের নাট্যধারা’ বলেই আখ্যায়িত করা হলো। ব্যাপারটি ‘নিজ
দেশে পরবাসী’ গোছের। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে কে ভুল, কে শুদ্ধ – সেই বিচার করা এই বক্তব্যের মুখ্য
উদ্দেশ্য নয়। এই বিশ্বায়নের যুগে সংস্কৃতির সাথে সংস্কৃতির বহুমূখী আদানপ্রদানের
মাঝে এটা কখনই আশা করা উচিৎ নয় যে, ‘বাংলা নাট্য’ ব্যতীত আমরা অন্য কোনো নাট্য
আঙ্গিকের সহিত নিজেদের পরিচয় ঘটাবো না। অবশ্যই আমরা ব্রেখটিয়ান রীতিতে কাজ করব;
মায়ারহোল্ড, গ্রটস্কি, শেকনার, ব্রুক, বোআল, সবার নাট্যচর্চার মূল্যায়ন করতে হবে।
কিন্তু আসল বিষয়টি হলো মানসিকতার, আমাদের ভাবনার। অন্যের সংস্কৃতিকে স্বাগতম
জানাতে গিয়ে যদি এমন হয় অতিথিই মালিক হয়ে উঠেন আর মালিক অতিথি বনে গেল তাহলে
বিষয়টি সত্যিই আশংকাজনক। আর তাই, এই প্রশ্নটি বার বার উঠে আসে, সংখ্যাগরিষ্ঠ
নাট্যমোদী যারা ইউরোপীয় রীতিতে নাট্যচর্চা করছে তাদের নাট্যচর্চাকে আমরা
‘মূলস্রোত’ না ‘বিপরীত স্রোত’ বলব নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ প্রধানত গ্রামীন
জনপদের যারা বাংলা সংস্কৃতিকে অন্তরে লালন করে আবহমান কাল ধরে নাট্যচর্চা করে আসছে
তাদের নাট্যচর্চাকে ‘বিপরীত স্রোত’ না ‘মূলস্রোত’ বলব। আমাদের কাছে আপাতত এর কোনো স্হায়ী সমাধান
নেই কারণ ২০০ বছরের মধ্যখণ্ডনে ‘নিজের’ এবং ‘অন্যের’ – কোনটা কার তা আলাদাভাবে
পার্থক্য করা খুব সহজ হয়তো নয় তাই ওটা সময়ের উপরেই ন্যস্ত থাকল, সময়ই এর সমাধান
করবে।
যাহোক্ এই
‘মূল স্রোত’ ও ‘বিপরীত স্রোত’ ছাড়াও অন্য একটি ‘বিকল্প ধারা’ রয়েছে তবে সেটি
কোনোভাবেই ‘দেশীয় রীতির নাট্য’ শৈলীতে তার নাট্য উপস্হাপনার দায়ভার বহন করেনা
বরঞ্চ ‘বিকল্প’ এই অর্থে বলা যায় যে, তারা ‘মূলস্রোতের নাট্যধারা’র প্রসেনিয়াম
কেন্দ্রিক নাট্য প্রযোজনায় নিজেদের আবদ্ধ করতে চাননা তাই তারা নাট্য প্রযোজনার
স্হানকে প্রসেনিয়ামের বিকল্প হিসেবে দেখাতে চান। তবে উপস্হাপনের ক্ষেত্র পরিবর্তন
হলে স্বাভাবিকভাবেই তার উপস্হাপন পদ্ধতিরও পরিবর্তন আবশ্যক, সেই অর্থে অবশ্যই তারা
হয়তো ‘বিপরীত’ কিন্তু সেটি কোনোভাবেই দেশীয় রীতির নাট্যশৈলীর প্রবাহতা ধারন করে
না। যার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে বাদল সরকার প্রণীত ‘থার্ড থিয়েটারে’র কথা বলা যেতে পারে। ৭০-এর দশকের
পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলনে বাদল সরকারের কৃতিত্ব এই যে, তিনি তার নাট্যভাবনাকে
২০০ বছরের বাংলা নাট্যচর্চার প্রথাগত ইউরোপীয় ভাবধারার প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা
করেছেন কিন্তু নতুন নাট্যশৈলী গঠনে আবার সেই ইউরোপেরই দ্বারস্হ হয়েছেন। তার এই
তৃতীয় থিয়েটারের রূপকে তিনি সাধারণভাবে তিনটি কথায় বুঝিয়েছেন, তা হলো ১) যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্হায় করা যায় ২) যা সহজে স্হানান্তরে নিয়ে যাওয়া যায় ৩) যা অর্থের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল নয়। এই নতুন
ধারার নাট্যশৈলী হয়তো গ্রাম-বাংলার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছাকাছি অবস্হান করেছে কিন্তু
‘দেশীয় রীতির বাংলা নাট্যে’র অগ্রসরতায় ‘থার্ড থিয়েটার’-এর আলাদা করে কোনো ভূমিকার
উল্লেখ পাওয়া যায় না, মূলত একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শে সমাজ পরিবর্তনের প্রয়োজনে বা উদ্দেশ্যে এই নাট্যরীতির জন্ম
হয়েছিল বলেই বোধ হয়।
উপসংহার
সতিনের সঙ্গে ঘর করিতে গেলে তাহাকে খাটো হইতেই হইবে। বিশেষত
সতিন যদি প্রবল হয়। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭৩)
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে
আমাদের কারো বুঝতে কষ্ট হয়না যে, রবীন্দ্রনাথ কাকে ‘সতীন’ বলছেন। পরিতাপের
বিষয় এই যে, ‘সতীন’ পরিত্যাগ করা গেছে কিন্তু তার রেখে যাওয়া হাব-ভাব,
আচার-ব্যবহার এতটাই আপন হয়ে গেছে যে, ছাড়তে চাইলেও ছাড়া যাচ্ছে না। যাহোক্,
‘মূলস্রোত’ এবং ‘বিপরীত স্রোত’ – এই নাট্যধারা দু’টির এপর্যন্ত
আলোচনায় এটুকু হয়তো প্রমাণিত হয়েছে
যে, ইউরোপের তুলনায় আমাদের নাট্যচর্চা অনেক বেশী সহজ, সরল; মোট কথা আমাদের নাট্যশৈলী তাদের মতো দুর্বোধ্য কাঠামোয় মোড়া
নয়। ২০০ বছরের পরাধীনতার যে দাগ তা আমরা আজও স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে দৈনন্দিন জীবনের পাশাপাশি
নিজস্ব সংস্কৃতির গর্ভেও লালন করে চলেছি। আজ সময় এসেছে বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে
বাংলা ভাষায়, বাঙ্গালী রীতিতে, বাংলার নিজস্ব মঞ্চে আপামর বাঙ্গালী দর্শককে সাথে
নিয়ে বাংলার নিজস্ব নাট্যশিল্পকে সারা পৃথিবীর কাছে তুলে ধরবার। তাহলেই বাংলা ভাষা
বাঁচবে, বাঙ্গালী সংস্কৃতি বাঁচবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শেষের কথাটি দ্বারা নতুন
শুরুর দিকে আজকের এবং আগামী প্রজন্মের কাছে এই বার্তা পৌঁছানো আবশ্যক যে, “বাগানকে
যে অবিকল বাগান আঁকিয়াই খাড়া করিতে হইবে এবং স্ত্রী-চরিত্র অকৃত্রিম স্ত্রীলোককে
দিয়াই অভিনয় করাইতে হইবে, এইরূপ অত্যন্ত স্হূল বিলাতি বর্বরতা পরিহার করিবার সময়
আসিয়াছে” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭৮)।
১ সৈয়দ জামিল আহমেদের হাজার বছর: বাংলাদেশের নাটক ও
নাট্যকলা বইটির সূত্র ধরে এই প্রবন্ধের মধ্যেও যে কোনো নাট্যের লিখিত পাঠকেই এখানে নাটলিপি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেটা হতে
পারে মূল পাণ্ডুলিপি অথবা প্রযোজনা পাণ্ডুলিপি।
২ নাট্য শব্দটি এখানে ইংরেজী ‘থিয়েটার’ শব্দের বিপরীতে
ব্যবহৃত হয়েছে।
৩ ওড্র-মাগধী রীতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ‘নাট্যশাস্ত্রে’ বলা হয়েছে যে, এই
প্রবৃত্তি ভারতী ও কৈশিকী বৃত্তির আশ্রয়ে রচিত হয়ছে। অর্থাৎ ওড্র-মাগধীরীতি এই
দুইটি বৃত্তি অবলম্বনে প্রযুক্ত হয়। কৈশিকী বৃত্তির নিমিত্তে ব্রহ্মা
স্বতন্ত্রভাবে ত্রয়োবিংশ অপ্সরা সৃজন করেছিলেন। এ বৃত্তি শিবের শৃঙ্গার নৃত্য থেকে
উদ্ভূত। নারীর অংশগ্রহন ব্যতিরেকে কৈশিকীর প্রয়োগ সম্ভব নয়। নাট্যশাস্ত্রে এর
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বসন-ভূষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। শাস্ত্রমতে কৈশিকী বৃত্তিতে আহার্য
হবে মনোরম, এর আত্মা হচ্ছে ‘ক্রিয়া’ এবং ‘রস’। এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভরত বলেছেন
যে, এ বৃত্তি ‘বহুনৃত্তগীতবাদ্য’ সংযুক্ত ললিত-অঙ্গাভিনয়। এখানে ভরত-প্রোক্ত
‘নৃত্ত’ শব্দটির ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ‘নৃত্য’ ও ‘নৃত্ত’ রীতি ও প্রয়োগ
বিচারে ভিন্ন। ‘নৃত্ত’ হলো ছন্দে তালে সাধারণ অঙ্গভঙ্গি। এ হচ্ছে জননন্দিত লৌকিক
নাট্যাভিনয়। এতে নাট্যশাস্ত্র নির্দেশিত মার্গীয় মুদ্রারীতি অনুসৃত হয়না। ‘নৃত্ত’
শব্দটি কৈশিকী প্রসঙ্গে উল্লিখিত হওয়ায় প্রাচীনকালের ওড্র-মাগধী নাট্যরীতির
বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা যায়। প্রাচীন বাঙলার যে ক’টি নাট্যরীতি এ যাবত আবিষ্কৃত হয়েছে, দেখা যায়
যে, সেগুলো লৌকিক নাট্যাভিনয়রীতি অর্থাৎ ‘নৃত্তে’র আশ্রয়ী। (সেলিম আল দীন ২)
তথ্যসূত্র
আহমেদ, সৈয়দ জামিল। হাজার
বছর: বাংলাদেশের নাটক ও নাট্যকলা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী: ঢাকা, ১৯৯৫। প্রিন্ট।
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ। “রঙ্গমঞ্চ”।
বিচিত্র প্রবন্ধ। বিশ্বভারতী গ্রন্হনবিভাগ: কলিকাতা, ভাদ্র ১৪০১। পৃ: ৭৩-৮। প্রিন্ট।
দীন, সেলিম আল। মধ্যযুগের
বাংলা নাট্য। বাংলা একাডেমী: ঢাকা, ১৯৯৬। পৃ: ১৪। প্রিন্ট।
Awasthi,
Suresh. Performance Tradition in India. Rpt. National Book Trust, India:
2009. n.pag.
Print.
Comments
Post a Comment