প্রবন্ধ - ‘থিয়েটার’-এর উলটপুরাণ : প্রেক্ষিত ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’
প্রকাশ: বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার ঢাকা বিভাগের মুখপত্র
বর্ষ: ১
সংখ্যা: ২
প্রকাশকাল: জানুয়ারী-জুন ২০১৬
সম্পাদনা: কামরুল হাসান খান
‘থিয়েটার’- এর উলটপুরাণ : প্রেক্ষিত ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’
বিভাস বিষ্ণু চৌধুরী
বিভাস বিষ্ণু চৌধুরী
এটি কোনো
তথ্য উপাত্ত সম্বলিত কোনো প্রবন্ধ বা নিবন্ধ নয়, পি.এইচ.ডি.-এর প্রয়োজনে বাংলাদেশের
নাট্য পরিমণ্ডলের একটি জাতীয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’-এর ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রটি
হাতে এলে শিরোনামের বিষয়টি নিয়ে একটি প্রশ্ন জাগে যার উত্তর খুঁজতে গিয়েই লেখাটির
জন্ম। বাংলাদেশের বাইরে যারা ‘গ্রাম থিয়েটার’ সম্পর্কে অবগত নন সেই ধরনের
অবাঙ্গালী অথবা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ বাঙ্গালী নাট্যমোদী মাত্রেই বাংলাদেশের
এই ‘গ্রাম থিয়েটার’ বলতে বুঝে থাকেন – ‘গ্রামের থিয়েটার’ অথবা ‘গ্রাম কেন্দ্রিক
থিয়েটার’। আসলে কি তাই? হয়তো তাই আবার হয়তো নয়। তবে তাদের এই বোঝা না বোঝায় আপাত
দৃষ্টিতে খুব একটা কিছু আসে যায় না। তবে সমস্যাটি তৈরী হয় যখন নানান বিষয়ে খুঁটিনাটি
প্রশ্ন তৈরী হয় তখন। আর তাই, নির্দিষ্টভাবে উল্লেখিত এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় আসতে
গেলে একটু পিছন ফিরে ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ এর জন্মলগ্নের কারণ, আদর্শ, লক্ষ্য
ও উদ্দেশ্যের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’-এর
সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু (নির্দেশক-‘ঢাকা থিয়েটার’) একটি বিদেশী ম্যাগাজিনে
দেওয়া সাক্ষাৎকারের আলাপচারিতার এক পর্যায়ে ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ সম্বন্ধে
বলেন,
‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ ১৯৮২ সালে শুরু হয়। এর প্রাথমিক
চিন্তাভাবনা মোটামুটি ১৯৮০ সালে আমাদের মাথায় আসে। আমাদের যে লোকজ বা ঐতিহ্যবাহী
নাট্যরীতি সমূহ আছে, উপস্হাপনা সমূহ আছে, লেখ্যরীতি সমূহ আছে – এগুলো সম্পর্কে
সম্যক ধারণা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেওয়ার কোনো ব্যবস্হা বাংলাদেশে নেই। কিন্তু আমাদের
সমাজে, গ্রামে, হাটে, ঘাটে, উঠানে, আঙ্গিনায়, পূজাপার্বন, উৎসব উপলক্ষে যে
ঐতিহ্যবাহী সংগীত, নৃত্য এবং নাট্য পরিবেশিত হয়, যে পালাগান পরিবেশিত হয়;
মনসামঙ্গলের রীতি অনুসরণে যেসব উপস্হাপনা হয়; গম্ভীরা, লেটো, আলকাপ এই সকল কিছুর সম্পর্কে আমাদের
সম্যক ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরী বলে আমি [বা আমরা] মনে করেছি। [আর ঠিক] তখন সেলিম আল দীন-এর হাতে তালুকনগরে [তার শ্বশুড়বাড়ী] একটি
মেলাপত্তনের (আজহার বয়াতীর মেলা) মধ্য দিয়ে আমাদের ‘গ্রাম থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
(Thespian Magazine <http://www.thespianmagazine.com/interview.php?type=bengali>
acc. Date 03/12/2015)
তাহলে আমাদের সমাজে, গ্রামে, হাটে, ঘাটে, উঠানে, আঙ্গিনায়,
পূজাপার্বন, উৎসব উপলক্ষে এইসকল ঐতিহ্যবাহী সংগীত, নৃত্য এবং নাট্য পরিবেশনা; মনসামঙ্গলের
রীতি অনুসরণে যেসব উপস্হাপনা; গম্ভীরা, লেটো, আলকাপ এই সকল কিছুর সম্পর্কে যদি সম্যক জ্ঞান লাভ করতেই হয় তাহলে কি আমরা সেটা ইউরোপে
বসে জানব, শিখব নাকি বাংলায় বসে। আমাদের মনে হয় এখন সময় এসেছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত
কঠোর মৌলবাদী আচরণ করবার যেখানে কোনো বিদেশী ভাবধারা নিজের দেশের মাটিতে অবাঞ্চিত
মনে হলে সত্যি সত্যিই সেটা বিষফোঁড়ার মত সমূলে উপড়ে ফেলা উচিৎ; আর তাতেই বাংলা
নাট্য বাঁচবে, বাঙ্গালী বাঁচবে, বাংলা বাঁচবে।
স্বাধীন
বাংলাদেশের জাতীয় নাট্যচর্চায় আজতো এটা প্রমাণিত যে, বাঙ্গালীর নাট্যচর্চার ধারা
হঠাৎ উদ্ভাবিত কোনো বিদেশী ভাবধারাপুষ্ট ২০০ বছরের খণ্ডিত ইতিহাস নয়। এটির হাজার
বছরের ঐতিহ্য রয়েছে যা সংস্কৃত নাট্যশাস্ত্রেরও পূর্ববর্তী। আর সেই হিসেবে ২০০
বছরের ইংরেজ আমলে ইউরোপীয় ভাবধারায় গঠিত পরজীবি নাট্যরীতি বর্জনের কথা বলছি অথচ
বাঙ্গালীর নিজস্ব নাট্যশৈলীপুষ্ট নাট্যরীতি চর্চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত
নাট্যসংগঠনগুলোর নামের পাশে বিশেষ করে ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ গোষ্ঠীভুক্ত
নাট্যসংগঠনগুলোর নামের পাশে ‘থিয়েটার’ শব্দটি অবলীলাক্রমে ব্যবহার করে চলেছি।
সবচেয়ে উল্ল্যেখযোগ্য যে দুটি বিষয় অত্যন্ত পীড়াদায়ক তা হলো – ‘বাংলাদেশ গ্রাম
থিয়েটারে’র মত একটি জাতীয় সংগঠন যারা হাজার বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বলে
দাবী করে তাদের নামের পাশে ‘থিয়েটার’ শব্দটির কতটা প্রয়োজনীয়তা আজকের সময়ে দাবী
রাখে যেখানে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাট্যরীতি বলতেই সকলে ‘বর্ণনাত্মক
নাট্যরীতি’কেই বুঝে থাকেন; ‘চরিত্রাভিনয় রীতি’কে নয়। সেই প্রেক্ষিতে আজ এটি অবশ্যই
বিচার্য যে, ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ আসলে ‘থিয়েটার’ শব্দের পূর্ব পুরুষদের
ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার দাবী করে কিনা। আমরা জানি এবং আমাদের উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই
কথাটি অবশ্যই স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ এই উত্তরাধিকার বহন করেন
না বা দাবীও করেন না তাহলে কেন ‘বাংলা নাট্যে’র সাথে তাদের এই সংঘাতপূর্ণ বৈষম্যতা।
যদিও ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’- এর নামটি থেকে ‘থিয়েটার’ শব্দটির কোনোরূপ প্রতিস্হাপন
আজ প্রায় ৩০ বছর পরে সম্ভব কিনা আমাদের জানা নেই। এর দায়ভার ‘বাংলাদেশ গ্রাম
থিয়েটারে’র কর্তাব্যক্তিদের কাছেই তোলা রইল। যাহোক্, এটি গেল একটি বিষয়। আর
দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো – ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ তার গঠনতন্ত্রের
ধারা বর্ণনার একেবারে শীর্ষে (ধারা : ১) যে ধারাটি যোগ করেছে তা হলো “ইউনিট
পর্যায়ে সংগঠনের নামের শেষে ‘থিয়েটার’ [শব্দটি] অবশ্যই থাকতে হবে” (ঘোষনাপত্র ও
গঠনতন্ত্র, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার)। এইখানে এসেই আমরা অদ্ভুতভাবে দেখতে পাই, যে
প্রতিষ্ঠানটি ২০০ বছরের মধ্যখণ্ডনে সৃষ্ট নাট্যরীতির চলনে কোনো বিশ্বাসই রাখে না;
তারাই আবার এক ছাতার তলে মিলিত হচ্ছে একটি ধার করা বিদেশী শব্দকে আদর্শ ধরে। এটা
কি ঠিক? আজ জাপান যদি তার ‘নো’কে ‘নো থিয়েটার’ না বলে শুধু ‘নো’ বলতে পারে;
ইন্দোনেশিয়া যদি তার ‘রামলীলা’কে শুধু ‘রামলীলা’ বলতে পারে তাহলে আমাদের তথা
বাঙ্গালীর নিজস্ব নাট্য আঙ্গিকের পরিচয় প্রদান করতে এখনও কেন ‘থিয়েটার’ শব্দের ব্যবহার
বাধ্যতামূলক করে রাখতে হবে ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’কে।
এই পর্যায়ে
‘থেস্পিয়ান ম্যাগাজিনে’ নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সাক্ষাৎকারের কিছু
অংশ তুলে ধরবার প্রয়োজন বলে বোধ হয়। তিনি বলছেন,
...আমাদের মনে [হয়েছে] ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে আমরা যেখান থেকে বিচ্যুত এবং
শেকড়চ্যুত হয়েছিলাম তার শেকড় বা উৎসর সন্ধানে সেখানে আবার ফিরে যাওয়া ঠিক নয়।
বরঞ্চ সেই শেকড়ের সাথে সংযোগ করে মাটি থেকে রসটা নিয়ে হাত পা সবকিছু আকাশে মেলতে
হবে। দেখতে হবে তার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সাথে কি সম্পর্ক স্হাপন করল। তার জন্য আমরা
বলছি, ‘বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে বেজে উঠুক দেশকালের অতীত, বাংলা মঞ্চের শাশ্বত সুর’ আর একটি
স্লোগান আছে ‘গ্রাম থিয়েটারে’র – ‘হাতের মুঠোয় হাজার বছর আমরা চলেছি সামনে’। সেই চর্যাপদের
কাল থেকে আমাদের নাট্যের শুরু। তাহলে কেন আমরা বলতে যাচ্ছি আমাদের নাটক দুইশত বছরের, লেবেদেফ
আসার পর থেকে।
তাহলে উপরোক্ত
অংশটিতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ আমাদের বারবার মনে করিয়ে
দিচ্ছে হাজার বছরের বাংলা নাট্যরীতির কথা অথচ সেই সংগঠনটিই তার নিজের পরিচয়ে ‘থিয়েটার’
শব্দের ব্যবহার দ্বারা বহন করে চলেছে শুধু দুইশত বছরের ইতিহাস। কারণ এই বাংলায় তথা
সমগ্র ভারতবর্ষেই ‘থিয়েটার’ শব্দের আবির্ভাবের কালটা যতদূর জানা যায় সেটি অষ্টাদশ
শতাব্দীর শেষভাগ। আর বাঙ্গালীর মানসে এই শব্দটির প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় গেরাসিম
স্তেপানোভিচ লেবেদেফ – এর প্রথম বাংলা ভাষায় অভিনীত একটি বাণিজ্যিক নাট্যশালার
উৎপত্তির মাধ্যমেই। যার নাম ছিল Bengally Theatre। এর পূর্বে ‘থিয়েটার’ শব্দটির কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যবহার বাঙ্গালীর
সাথে ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই।
পরিশেষে বলা
যায় যে, কী কারণে, কোন্ প্রেক্ষাপটে ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’ তার কর্মপ্রক্রিয়া
শুরু করেছিল তার কমবেশী সবটাই এখন আমাদের জানা। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধউত্তরকালে
যখন বাংলানাট্যের শেকড় সন্ধানের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো – তখন কিন্তু বাংলানাট্যের
হাজার বছরের অস্তিত্ব বহমান থাকলেও কাগজে কলমে তা স্বীকৃত ছিলো না; যার অস্বিত্ব
এখন সর্বতোভাবে স্বীকৃত। এবং আমরা জানি সেই অস্তিত্বের স্বীকৃতির উত্তরাধিকার
একমাত্র ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’-ই দাবী করতে পারে। আর তাই, আজকের প্রেক্ষাপটে
দাঁড়িয়ে কী কারণে ‘থিয়েটার’ শব্দের ব্যবহার দ্বারা ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’-এর
শুরু হয়েছিল সেই ভাবনা নিয়ে আলোচনা করাটাই ‘excuse’ বলে মনে হয়।
Comments
Post a Comment