নাট্য আলোচনা - ডাকঘর
প্রযোজনা: কলাক্ষেত্র মণিপুর
নির্দেশনা: হেইসনাম কানাইলাল
আমার দেখা ‘ডাকঘর’ ও একটি মণিপুর
বিভাস বিষ্ণু চৌধুরী
বিভাস বিষ্ণু চৌধুরী
একটি পঞ্চাশ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য
মঞ্চচিত্র দেখতে পেলাম ২৪শে মার্চ (২০১৯) সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনের ‘লিপিকা’
প্রেক্ষাগৃহে: প্রয়াত হেইসনাম কানাইলাল নির্দেশিত রবি ঠাকুরের ডাকঘর। একটি অনবদ্য
নাট্য প্রযোজনা। প্লট আমাদের সকলেরই অত্যন্ত পরিচিত, আর সেই নিয়েই কিছু কথা।
কানাইলালের নাট্য প্রযোজনার সাথে মোটামুটি পরিচয় ঘটে ২০১২/১৩ সালে কোলকাতায়; ওনার
ভুবনখ্যাত নাট্যপ্রযোজনা মহাশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী। সন তারিখের একটু এদিক
সেদিক হতে পারে। এবারে ডাকঘর। ইমা (সাবিত্রী হেইসনাম) এসেছেন শান্তিনিকেতনে
তার অনন্য অভিনয় শৈলীতে আমাদের মুগ্ধ করতে। তিনিই তো ডাকঘরের ‘অমল’। আমরা
নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি কেউ ‘অমলে’র কথা আর সেই ‘দইওয়ালা’। ছোটোবেলায় কত পড়েছি “দই,
দই, দই, ভালো দই! সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় শামলী নদীর ধারে গয়লাদের বাড়ির দই।
... দই, দই, দই...! এরকম কত স্মৃতি। নাটক শেষে কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজে কেঁদে
গেলেন আমাদেরকেও কাঁদিয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি এত ভালোবাসা অবাঙ্গালী কোনো
নাটকের মানুষের মধ্যে এর আগে কখনও দেখিনি। শান্তিনিকেতনে আসবার জন্য কানাইলাল জীর
যে অপরিসীম ইচ্ছা তাঁর সারাজীবন জুড়ে লালন করেছেন সেই কথাটি বলতে গিয়েই নিজের
চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। শুনতে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে কানাইলালজী জীবিত
থাকাকালীন শান্তিনিকেতনে আসতে পারলে স্বামী-স্ত্রী দুইজনেরই হয়তো স্বয়ং
রবীন্দ্রনাথ দর্শন হতো। কত গভীর উপলব্ধি নিয়ে এই মানুষগুলো রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন,
পড়েছেন, অনুভব করেছেন তারপর মঞ্চে উপস্হাপন করেছেন। অথচ আজকের কোলকাতা বা তদ্সংলগ্ন
বাংলার নানা জায়গায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে রবীন্দ্রনাথের নাট্যশৈলীর যে উপর্যুপরি
ধর্ষণ ক্রমাগত হয়ে চলেছে তা আর চোখে দেখা যায়না। এই নাটকটিও কিন্তু একটি
পরীক্ষামূলক প্রযোজনা কিন্তু কোথাও আমরা একচুল বিচ্যুত হইনি ডাকঘরের
নাট্যরস এবং রবীন্দ্র দর্শন থেকে। একটি গল্প বলে আপাতত এই অংশের সমাপ্তি টানছি।
গল্পটি উনি করলেন পরদিন বৃক্ষ পরিবেষ্টিত ছায়া ঘেরা ‘কলা ভবন’-এর ‘চাতালে’ বসে।
যুবক বয়সে কানাইলাল জীর বাবা-মা তাকে পাঠিয়েছিল এলাহাবাদে – কৃষি বিষয়ে
পড়াশোনা করতে। কিন্তু সেখানে কোনোভাবেই তাঁর মন টিকছিল না। সারাদিন নানা জায়গায়
ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। মাঝে মাঝে ত্রিবেণী সঙ্গমে যেতেন হিন্দী সিনেমার শ্যুটিং
দেখতে। এবং সেটা প্রায় সময়ই যেতেন। শেষে আর কোনোভাবে টিকতে না পেরে পড়াশোনা শেষ না
করেই সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে আবার চলে এলেন মণিপুরে। সব ফেলে চলে এসেছিলেন, শুধু হাতে
ছিল রবি ঠাকুরের একটি পূর্ণাবয়ব ছবি।
কি অসাধারণ তাইনা!! ভাবাই যায় না।
এই লেখাটি মূলত এগোবে ডাকঘর
প্রযোজনার উপস্হাপনা ও ইমার অভিনয়ের সুদক্ষতা এবং ‘কলাক্ষেত্র মণিপুর’ তথা
নির্দেশক কানাইলাল জীর নাট্যদর্শনের আঙ্গিকের উপর ভর করে। গত চার বৎসর যাবৎ নানাভাবে
শান্তিনিকেতনের নানা মানুষজন ডাকঘর নাটকটিকে শান্তিনিকেতনে মঞ্চস্হ করানোর চেষ্টা
করেছেন। সেই মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম হলেন ‘কলা ভবনে’র পেইন্টিং বিভাগের অধ্যাপক
সঞ্চয়ণ ঘোষ। সেই সাথে আছেন ‘ভাষা ভবনে’র অধ্যক্ষ তথা ইংরেজী বিভাগের মাষ্টারমশাই অধ্যাপক
অভিজিৎ সেন এবং অন্যান্য আরও অনেক সুহৃদ। যাহোক্, বছর জুড়ে পালিত হওয়া ‘কলা ভবনে’র
শতবর্ষ পূর্তি উৎসবের অংশ হিসেবে ভারত সরকারের ‘সংগীত নাটক আকাদেমি’র আর্থিক
সহযোগীতায় এই পুরো কর্মযজ্ঞটি অবশেষে সম্ভবপর হয়েছে। এবার শোনা যাক্ কবে কখন
কীভাবে উত্তর-পূর্বের এক নিভৃত গ্রামের কিছু প্রান্তীয় মানুষের নিত্য অনুষঙ্গী হয়ে
উঠল এই ডাকঘর নাটকটি। ২০০৫/০৬ সালের কোনো এক সময়ে ভারতবর্ষের অপর একজন
প্রথিতযশা নির্দেশক হাবীব তানভীরজী কানাইলাল জীকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন রবি ঠাকুরের
১৫০ তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটক নিয়ে কাজ শুরু
করতে। সেই উৎসবে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন হাবীব তানভীর (বিসর্জন), কে. এম.
পানিক্কার (চণ্ডালিকা), সুমন চট্টোপাধ্যায় (রক্তকরবী)। প্রথমে যদিও উনি রক্তকরবী করবেন বলে মনস্হ করেছিলেন;
পরে হাবীব তানভীরজী তাকে বলেছিলেন, ডাকঘর করতে। সেই শুরু কানাইলালের ডাকঘরের
পথচলা। আজ তিনি নেই ঠিক কিন্তু রয়ে গেছে গুরুদেবের সাথে তাঁর এক অনন্য শিল্পসুঁতোর
বন্ধন যা কালের যাত্রায় নিত্য প্রবাহমান।
এতক্ষণের
এত বকবকানির পর পাঠকের মনে হয়তো দুটি প্রশ্ন জাগতেই পারে। প্রথমটি হলো কেন ‘অমল’
চরিত্রের জন্য একজন মহিলাকে বাছা হয়েছে এবং দ্বিতীয়টি হলো ‘অমল’ এত বাচ্চা একটি
চরিত্র; সেখানে যিনি অভিনয় করছেন তিনি কীভাবে একজন ষাটোর্ধ মানুষ হন? খুব সাদা
চোখে দেখলে বলতাম যে, দলের সবচেয়ে যিনি দক্ষ অভিনেত্রী এবং তায় আবার নির্দেশকের
কর্ত্রী - তাই তাকে দিয়েই করানো হয়েছে মূল চরিত্রটি। কিন্তু সাদা চোখে সব সাদা যায়
নাকো দেখা। যদিও কম-বেশী এটাই বাংলার সকল বড় বড় সাইনবোর্ডওয়ালা নাটকের দলগুলোর
নিত্য ছবি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না আমরা কানাইলাল এবং তাঁর ‘কলাক্ষেত্র মণিপুর’কে
নিয়ে কথা বলছি। আমরা সকলেই জানি বৈষ্ণব হিন্দু ধর্মের প্রভাব কতটা প্রবল মণিপুরে।
আর সেই বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান ধর্মীয় বিষয় হলো নাম সাংকীর্তন। আমরা যারা বাংলা
পালা, কীর্তন এই বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত তাদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে পালা বা কীর্তনে
সর্বদা একজন গায়েন বা পালাকার বা কীর্তনিয়া একাই সকল চরিত্রে অভিনয় করে। সেই কৃষ্ণ
হয়, তো সেই রাধা। এটাই বাংলা নাট্যের মূল বৈশিষ্ট্য – সুরে, গানে, পদে-পয়ারে গল্প এসে
ভর করে মানুষের মনে সেখানে ছেলে-মেয়ের কোনো ভেদ থাকে না। আমাদের পালাপ্রিয়
বাঙ্গালীর চোখে একজন মহিলাকে বা বলা ভাল একজন দাপুটে অভিনেত্রীকে ‘অমল’ চরিত্রে
মঞ্চারোহন করতে দেখে বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস হয়নি যে তিনি ‘অমল’ নন। আর নাট্যের শুরু
থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত তিনি তার অভিনয় শৈলী দিয়ে একবারের জন্যও দর্শকের মনোযোগ
‘অমল’ থেকে বিচ্যুত হতে দেননি। আর সেই সাথে সুরাশ্রিত সংলাপ নাটকের সুরের সাথে তাল
মিলিয়ে এমন একটা আবেশ তৈরী করেছিল – দর্শক হিসেবে মনে হতেই পারে আমরা যেন কোনো এক
নির্জন পাহাড়ী জনপদে একা একা জঙ্গল পরিবেষ্টিত গাছ-পাখীর মিলিত সুরের মুর্ছনা
নিবিষ্ট মনে অবগাহন করছি। পাঠক নিশ্চয়ই কখনও না কখনও সবুজ ঘেরা পাহাড়ী নৈ:শব্দের
সরু পথে গিয়ে থাকবেন। চোখ বুজে কান পাতলে শুনবেন বাঁশেদের ঘর্ষণ সুর, গাছেদের আলাপ
আর পাখীদের কলকাকলি – কী অসাধারণ সেই মুহুর্তগুলো। এই পুরো নাটকটিতে যদি আপনি কখনও
চোখ বন্ধ রেখে কান পাতেন তাহলে এমনই কিছু সুর শুনতে পাবেন। মাঝে মাঝে কিছু কিছু সময়
আপনিই সুর কেটে যাবে খুব বিরক্তিকরভাবে। আর এখানেই একজন সফল নির্দেশক হিসেবে
কানাইলালের পটুতা। তিনি কয়েকটি চরিত্রের বাঁধনকে সুরের ব্যাঘাত ঘটবে বলেই বেঁধেছেন
এবং বাস্তবিক ভাবে দেখতে গেলে সেই চরিত্রগুলোই কিন্তু সমাজের নানারূপ কুকর্ম
পরিবেষ্টিত। যেমন: মোড়ল, ভণ্ড কবিরাজ প্রভৃতি। যাহোক্, সুরের প্রসঙ্গে একটা প্রসঙ্গ
বলে ক্ষান্ত হওয়া যাক্। আমরাও শুনে খুব অবাক হয়েছি যখন শুনেছি এই পুরো নাট্যের শুরু
থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত সুরগুলোই ছিল জীবন্ত। ভেবেই এক সার যে, এই পুরো সুরের আবেশ
কীভাবে জীবন্ত মঞ্চে আনা সম্ভব। তোম্বা (হেইসনাম তোম্বা – আবহ সঙ্গীত নির্দেশক)
বললেন, তারা কোনো ইলেক্ট্রিক্যাল বাদ্যযন্ত্র তো ব্যবহার করেননিই সেই সাথে কোনোরূপ
হারমনিয়াম, তানপুরা, সেতারের ব্যবহারও ছিলনা। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ছিল তিনটে
বিভিন্ন স্কেলের মেডিটেটিভ বাটি (বিশেষ ধরণের পিতলের বাটি) যার নাম ‘চাই-চেন’ ও
বাঁশ (বিভিন্ন পুরুত্বের) যার নাম ‘টুংফুং’, একটি বাঁশি, একটি মন্দিরা, এবং দুইটি
ছয় ইঞ্চি পেরেক যাকে তারা বলে ‘টিক টক’ আর সেই সাথে নিজেদের মুখনি:সৃত শব্দবাহার।
এই ছিল পুরো নাট্যের বাদ্যভাণ্ডার।
ইমার কাছ থেকে জানা যায় কানাইলাল
বাদল সরকারের কাজ দ্বারা অনেক প্রভাবিত হয়েছিলেন, তবে ডাকঘর নাটকটিতে বাদল
বাবুর প্রভাব ততটা আছে বলে মনে হয়নি। বরঞ্চ কানাইলালের অভিনয় রীতির অন্য অনেক
বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তন্মধ্যে মণিপুরের মার্শাল আর্ট ফর্ম ‘থাংতা’র সাথে
সাপের চলন মিশ্রনের চতুরতা অন্যতম। কানাইলালের কাছে ট্র্যাডিশনাল ফর্মের চাইতে খুব
গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ফর্মের ভিতরকার স্পিরিট এবং কন্টিনিউইটি যেটাকে তিনি তাঁর
প্রযোজনার নিজস্ব ভাষার প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করেছেন। ইমা বলছেন, চরিত্রটি
উপস্হাপন করতে গিয়ে তাকে খুব অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। তখন কানাইলালজী নানান
অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে পুরো কর্মটি পরিচালনা করেছেন। সেই সাথে তিনি বলতেন চরিত্রকে
নয়, চরিত্রের ভিতরের উচ্ছাস এবং সরলতাটাকে অনুভব করতে – আর এটাই ইমা দিনের পর দিন
অনুশীলন করে গেছেন। আর তাই তো আমরা মঞ্চে ‘অমল’কে দেখেছি; ইমাকে নয়। নাটক দেখার
সময় ততটা না মনে হলেও পরে মনে হয়েছে ‘অমলে’র এই চারিত্রিক সরলতাই প্রান্তীয় এই
মানুষগুলোকে রবীন্দ্রনাথের এত কাছে পৌঁছে দিয়েছে। সরল বলতেই মনে হলো, পুরো
নাটকটিতে সর্বমোট ছয়টি ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে – বাংলা, অহমিয়া, মণিপুরি, ত্রিপুরী
(কগবরগ), বোরো, রাভা। নির্দেশক প্রতিটি ভাষার আঞ্চলিক রূপকেই ব্যবহার করেছেন যদিও
বাংলা ছাড়া অন্য ভাষাগুলো আমাদের বোঝার কথা নয়। বাংলাটাতে প্রচণ্ডভাবে আঞ্চলিক টান
ছিল যেটা প্রযোজনার একটা নতুন দিক বলে মনে হয়েছে। পরবর্তীতে ইমার সাথে আলাপচারিতায়
জানা গেল, উনারা যে মণিপুরি ভাষা প্রযোজনায় ব্যবহার করেছেন সেটাও তাদের নিজস্ব
আঞ্চলিক ‘মণিপুরি’, ইম্ফল কেন্দ্রিক ‘মণিপুরি’ নয়। উনার যুক্তিতে আঞ্চলিক ভাষা
অনেক বেশী সুরেলা এবং খুবই সহজ ও সরলতায় পূর্ণ যেটা তাদেরকে নাট্যশরীরে প্রবেশ
করতে অনেক বেশী সহযোগীতা করেছে। তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, যে দুটি চরিত্র
বাংলা ভাষায় চরিত্রায়িত হয়েছে সেগুলো কিন্তু সামাজিকভাবে ‘খল’ চরিত্র যেমন: মোড়ল
এবং ভণ্ড কবিরাজ। এখানেই কোনো একটা জায়গায় মনে হতে পারে নির্দেশক হয়তো খুব
সুক্ষ্মভাবে মণিপুরে বাংলা ভাষার যে আগ্রাসন এত কাল ধরে চলে আসছে সেটার একটা নি:শব্দ
প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। আর সেটাই তো স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ। আমরাই তো সেই জাতি যারা
ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি অথচ আমরাই আবার অন্য ভাষার উপর নিজেদের আধিপত্য রেখে
দিয়েছি দিনের পর দিন। কিন্তু তারা বললেন, শুধুমাত্র মাতৃভাষায় স্বতস্ফূর্তভাবে
সংলাপ প্রক্ষেপণের জন্যই এইভাবে ভাষার ব্যবহার হয়েছে। তাতে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য
ছিলনা। এবং শুরুর দিকে নাটকটি যখন তৈরী হয় তখন অন্য কিছু চরিত্র বাংলায় কথা বলত
তার মধ্যে রয়েছে ‘অমলে’র পিসেমশাই ‘মাধব দত্ত’ চরিত্রটি। তবুও বলতে চাই পূর্বে না
হলেও এখন কিন্তু এর একটা অন্য মানে দাঁড়ায়। এবং বাঙ্গালী হিসেবে এই প্রতিবাদ মেনে
নিতে আমাদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় এবং থাকতে পারেনা। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প
দিয়ে শেষ করা যাক্। তাহলো -
নাট্য বিষয়ে শিক্ষা নিতে কানাইলাল গিয়েছিলেন দিল্লীর ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ
ড্রামা’ (এন.এস.ডি.) তে। সেখানে যেহেতু সবটাই হিন্দীতে চালিত হয় আর উনি হিন্দীতে
একেবারেই সড়গড় ছিলেন না। তখন এন.এস.ডি.-র দায়িত্বে ছিলেন ইব্রাহিম আলকাজী। হিন্দী
ভাষা রপ্ত করতে না পারার দরুণ ইব্রাহিম আলকাজী কানাইলালকে এন.এস.ডি. থেকে বহিষ্কার
করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আমরা সবাই জানি এই বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতার শিকার কানাইলাল
ভারত সরকারের তৃতীয় এবং চতুর্থ সিভিলিয়ান পুরষ্কার যথাক্রমে ‘পদ্মভূষণ’ এবং
‘পদ্মশ্রী’ তে ভূষিত হন।
এই বহিষ্কারটাই অবশ্য ‘শাপে বর’ হয়ে দেখা দিয়েছে। ইমা
বলছিলেন, তিনি তাকে সবসময় বলতেন তাঁর থিয়েটারের একটা নতুন ভাষা তৈরী হবে যেখানে
কথ্য ভাষার কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। এবং সেটা উনি তৈরী করে গিয়েছেন তাঁর নিত্য
নাট্যচর্চার মধ্য দিয়ে যার নাম ‘Theatre of the Art’ (নামটি প্রফেসর শিবপ্রকাশ কর্তৃক প্রদেয়)।
কানাইলালের নাট্যপ্রযোজনার মূল রসটাই
হলো আধ্যাত্মিকতার মিশেলে সহজ ভাবনা এবং সরল উপস্হাপনা। রবীন্দ্রনাথের নাটকে
চরিত্রের নামগুলো সাধারণভাবে কাহিনীর প্রেক্ষাপটের দ্বারাই সৃষ্ট। সেক্ষেত্রে ‘অমল’
মানে যদি হয় অমলিন মন তাহলে ‘সুধা’ মানে রস বা প্রেমসুধাকেই হয়তো বোঝায়। এই
সুক্ষ্মরসবোধটাকেই তিনি একটা আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছে দিয়েছেন। আমরা দেখতে পাই ‘সুধা’
যখন ‘অমলে’র কাছ থেকে ফুলটা কেড়ে নেয় তার পর থেকেই ‘অমল’ কিন্তু অসুস্হ্য হতে শুরু
করে। আর এর সাথেই উনি একটা আধ্যাত্মিক সংযোগ তৈরী করেছেন লম্বালম্বিভাবে Up Centre-এর ঠিক মাথার উপর থেকে ড্রাফারি মতন একটি ভ্রূণের
লাইন ড্রয়িংয়ের সাথে। প্রথমে মনে হচ্ছিল পোর্ট্রেট মতন কিছু একটা কিন্তু ওটা ছিল
একটা ভ্রূণের ছবি। এবং যারা নাটকটি দেখেছেন তারা সবাই দেখে থাকবেন ইমার হাতের চলন;
যেটা অবিকল একটি ভ্রূণের হাতের চলনের সাথে মিশে যাবে। একটু অন্য ভাবে ভাবলে দেখা
যাবে কানাইলাল হয়তো বলতে চেয়েছেন ডাকঘর যদি হয় পুরো শরীর আর চিঠি যদি হয়
তার আত্মা তাহলে একেবারে শেষ দৃশ্যে ইমা যখন লাল রঙ-এ আলোকায়িত ভ্রূণের ছবিটার ঠিক
নীচে Silhouette-এ দাঁড়িয়ে বলছেন “দেশে, দেশে, ... আফ্রিকা,
আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, ইণ্ডিয়া, হে চিঠি, হে চিঠি...”; সেখানে কোথাও একটা হয়তো জাতি,
ধর্ম, শ্রেণি থেকে শুরু করে আন্ত:দেশীয়, আন্ত:রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে একটি মেলবন্ধনের
আশা জাগিয়ে রাখে। কারণ শুদ্ধ, সুন্দর অঙ্কুর থেকেই তো সকল শুদ্ধতার জন্ম হয়। নাটকটি
মূলত: প্রসেনিয়ামের আঙ্গিকেই উপস্হাপিত হয়েছে। এবং এর নির্মাণ শৈলীটিও প্রসেনিয়ামের
উপর নির্ভর করেই তৈরী হয়েছে। আলোর ব্যবহারও ছিল অত্যন্ত সাবলীল। খুবই মিষ্টি একটা
আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে পুরো প্রযোজনাটি উপস্হাপিত হয়েছে। মঞ্চ করেছেন গোলক বড়ুয়া
এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল তাতুম্বা। আলো করেছেন ইবো চৌবা।
পরিশেষে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই
উসাম রোজিও কে যিনি ইমার সাথে আমাদের সমস্ত কথোপকথনকে ইংরেজীতে রূপান্তর করে
দিয়েছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ রোজিওকে। সেই সাথে ধন্যবাদ দিতে চাই বিদ্যুৎজিৎ চক্রবর্তীকে
যিনি নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন। সেই সাথে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা
জানাই আমার মাষ্টারমশাই দীপঙ্কর দাকে (রায়)। এই লেখাটি লিখতে তিনি নানাভাবে উৎসাহ
যুগিয়েছেন।
Comments
Post a Comment