নাট্য আলোচনা - নাচনী

প্রযোজনা: নান্দীকার
প্রকাশ: "Ekhon Santiniketan"
Vol: 1; Issue: 5 
প্রকাশকাল: জুন ২০১৯
পৃষ্ঠা: ৬০-১



পুরোনো গীত নতুন কথা: ‘নান্দীকারে’র “নাচনী”

বিভাস বিষ্ণু চৌধুরী

স্বাধীনতার প্রায় কিয়ৎকাল পরেই ষাটের দশকে ‘নান্দীকারে’র জন্ম। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আজও বিরামহীন তাদের পথ চলা। সেই পথচলায় আমরা নানান কিছুর সাক্ষী থেকেছি কয়েক প্রজন্ম ধরে। সেই শুরুর সময় থেকে এখনো বর্তমান যে কয়জন নাট্যজন ‘নান্দীকারে’ বিরাজমান তন্মধ্যে অন্যতম রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্ত এবং স্বাতীলেখা সেনগুপ্তএটাই আমাদের প্রাপ্তি যে এখনো স্বাতী দি এবং রুদ্র দাকে আমরা মঞ্চে চলতে ফিরতে দেখছি শুধু তাই নয় বরঞ্চ এই Stardom –এর যুগের অনেক প্রসিদ্ধ অভিনেতার চেয়ে অনেক বেশী তেজোদীপ্ত অভিনয়ে ঋদ্ধ তাদের মঞ্চচলন। আপনারা আরও সুদীর্ঘ কাল মঞ্চে বেঁচে থাকুন সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

গত ২৫শে এপ্রিল ‘লেডী রাণু মূখার্জী’ প্রেক্ষাগৃহে কোলকাতা মহানগরীর দর্শকরা আবারও সাক্ষী রইল দুই ঘন্টা কুড়ি মিনিটের একটি অভিনয় রজনীর। নান্দীকার প্রযোজিত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের রসিকউপন্যাস অবলম্বনে নাটক “নাচনী”। গ্রামবাংলার পথে প্রান্তরে পুরোনো পালা, পাঁচালী, নাটগীত রীতির নাট্যশৈলী খোঁজা এবং দেখার আগ্রহ থেকেই “নাচনী” প্রযোজনাটি দেখার একটি ইচ্ছা তৈরী হয়এই ভাবনা থেকেই যাওয়া যে, হয়তো নাচনীর form and content নিয়েই মূলperformance কারণ নামকরণ সূত্রে সেরকমটাই মনে হওয়ার কথাকিন্তু সেইরকম কিছু আসলে ছিল না। বরঞ্চ বলা যায়, এটি নাচনীদের জীবন নিয়ে একটি Docudramaমূলত “নাচনী” প্রযোজনাটি একটি সম্প্রদায়ের কথা বলে যেখানে নাচনী মেয়েরা গানের দলের রসিকের (নাচনীর বিপরীতে পুরুষ অভিনেতা) রাঁড় হয়ে বেঁচে থাকে সারা জীবন। এই রাঁড় আসলে রূপজীবিনী অর্থে ঠিক নয় বরঞ্চ বলা যায় এরা রসিকের একজন স্ত্রী কিন্তু কথিত অর্থে ঠিক স্ত্রীও নয়। আর সেই অর্থে একজন নাচনী মেয়ের উপর ব্যক্তিগতভাবে শুধু তার রসিকেরই একক অধিকার বিদ্যমান। এই নাচনীর দল নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে গান এবং নৃত্য সহযোগে দর্শক মনোরঞ্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে। সাধারণত: কামরসপূর্ণ গীত ও নৃত্যের সংমিশ্রনে এই ধরনের নাট্যক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

আমাদের যদিও জানা নেই নাট্যজনেরা “ঝুমুর” গান সহযোগে “নাচনী” নামক শিল্পকে বাংলা নাট্যঐতিহ্যের মধ্যে ফেলবেন কিনা কিন্তু আমরা এই ধরণের শিল্পকে আমাদের নাট্যঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করবযদিও আজকের এই আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক; কিন্তু বলতে ইচ্ছা হয় যে ‘তিলোত্তমা কোলকাতা’ যত না বেশী এই ধরণের শিল্প সম্পর্কিত মানুষদের ব্যক্তিগত জীবনে বেঁচে থাকা না থাকা নিয়ে উৎসাহিত হয়েছে ততটা কিন্তু এদের শিল্পকর্মের উৎকর্ষ সাধনে কখনই উৎসাহী হয়নি। বরঞ্চ এই ধরণের শিল্প শৈলীগুলিকে সেই British India-র শুরু থেকেই ‘ফাত্রা লোক’ বা ছোটোলোকের শিল্প বলে অবজ্ঞা করেছে যা আজো বিদ্যমান। “ঝুমুর” সহযোগে “নাচনী”র যে নিজস্ব একটা ধরণ আছে, সেই ধরণের উপস্হাপনার মধ্যে দিয়ে যদি এই নাট্যক্রিয়া এগোত তাহলে প্রযোজনাটি হয়তো আরও অনেক বেশী সমৃদ্ধ হতে পারত বলেমনে হয়তাতে সেই রীতি নিয়েও একটি পরিপূর্ণ তথ্যনির্ভর আধুনিক মঞ্চ উপস্হাপনা দেখা হত আর সেই সাথে তাদের জীবনের নানা উথ্থান পতনের সত্যিকার অবস্হানটাও ফুটে উঠত।

যাহোক্‌, প্রথমে আসা যাক্‌, এই প্রযোজনারText প্রসঙ্গে। Performance Text তৈরীতে নির্দেশক খুব একটা সার্থকতার পরিচয় দেননি আর তাই নাটকের গঠনশৈলীতেও অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয় ও দৃশ্যের অবতারনা ঘটেছে। প্রধান অভিনেতাদের অভিনয়ের স্পেস তৈরীর জন্য এই অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যগুলি রাখা হয়েছে বলেই বোধ হয়। এছাড়া পুরো প্রযোজনায় নির্দেশকের (পার্থ প্রতিম দেব) ভাবনার পরিব্যাপ্তির খুব একটা স্ফুটন ঘটেছে বলেও বোধ হয়নি। এই সময়ের কোলকাতার ষ্টার অভিনেতাদের অভিনয়ের তোড়েই নাট্যশরীর চালিত হয়েছে। এর আগেও অনেক নাটক দেখার সাক্ষী হিসেবে বলা যেতে পারে যে, আজকের কোলকাতার নাট্য নির্দেশকদের কোনো কারণ ব্যতিরেকে একেবারেই অপ্রয়োজনেদর্শক আসনের স্পেসকে অভিনয়ের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করাটা একটা gimik-এ পরিণত হয়েছে।

সারা ভারতবর্ষের শীর্ষস্হানীয় নাট্য সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সংগঠন ‘নান্দীকার’;কিন্তু প্রযোজনাটি দেখে একেবারেই‘নান্দীকারে’র প্রযোজনা বলে মনে হয়নি। কেননা রুদ্র দা, স্বাতী দি, সোহিনী, দেবশঙ্কর হালদারের মত গুণী অভিনেতাদের অভিনয় থাকলেও ‘নান্দীকারে’র প্রযোজনা হিসেবে যে Maturity থাকা প্রয়োজন সেটা একরকম ছিলনা বললেই হয়। প্রযোজনার ভাঁজপত্রটি হস্তগত না হওয়ার দরুন নির্দেশকের কথা এবং মঞ্চসজ্জা, আলো, আবহ ও পোষাক পরিকল্পনার বিস্তারিত তথ্যাবলী জানা সম্ভব হয়নি। তবে প্রযোজনা শুরুর আগে ঘোষণাপর্বের সূত্রে জানা যায়, আলো করেছেন জয় সেন এবং মঞ্চসজ্জায় ছিলেন দেবব্রত মাইতি। সেটের আধিক্যতা খুব বেশী না থাকলেও সেটের ডিজাইনটা দেখে মনে হয়েছে সেই নব্বইয়ের দশকের কোনো মঞ্চনাটক দেখছিলাম। আলোর বিষয়টাও তাইশুধু ‘নান্দীকার’ বলেই নয়; অন্যান্য নাটকের ক্ষেত্রেও দেখা যায়একাডেমী প্রেক্ষাগৃহে আলো ফেলা যেন একটা যুদ্ধ। আজ থেকে দশ পনেরো বছর আগেও আমরা যেমনটা দেখেছি এখনও ঠিক তেমনটাই আছে। এই যে এত বড় বড় নাট্যদলগুলো অভিনয় করছেন কোলকাতার এই মঞ্চগুলোতে তাদের কি কখনই এই পরিস্হিতি থেকে উত্তরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়নি নাকি তারা তাদের প্রযোজনার আলোক পরিকল্পনা নিয়ে ততটা ভাবিতই নন। নাই হতে পারেন, তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রসিদ্ধ নাট্যদলগুলোর প্রযোজনা মঞ্চস্হ করার জন্য অন্তত ১০ ঘন্টা আগে তাদেরকে মঞ্চ ছেড়ে দিতে হয়কারণ মঞ্চে তাদের আলোক পরিকল্পনার যথাযথ রূপায়ণ করতে গেলে ওই সময়টা তাদেরকে দিতেই হয়। তাহলে কোলকাতার বা পশ্চিমবঙ্গের নাট্যদলগুলোর জন্য কেন এমনটা দরকার হয়না? এর একটা উত্তর হয়তো হতে পারে; তা হলো, কোলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নাটক এখনও IPTA বা গ্রুপ থিয়েটারের যুগেই বাস করে আর মঞ্চ ব্যবহারের জন্য সেই যুগে প্রেক্ষাগৃহের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা এখনও সেইভাবেই চলে আসছেআর তার সাথে সাথে এখানকার যারা আলোক পরিকল্পনা করেন তাদের ডিজাইনটাও সেই যুগের মতই হতে হয় কারণ তার রূপায়ণের সময়সীমা তো ওইটুকুইআলো যে একটি চরিত্র সেটা নিয়ে না কখনও এখানকার নির্দেশকরা ভেবেছেন না কখনও ডিজাইনাররা। তাপস সেন মহাশয় কতটা ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে থেকে মঞ্চেকত বিশালতা ফুটিয়ে তুলেছেন সেটা নিয়ে মুখরোচক চর্চা করতে করতেই আমরা কয়েক দশক পার করে এলাম কিন্তু আর একটা তাপস সেন তৈরী করলাম না।এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী যে, পশ্চিমবঙ্গের সকল সরকারী প্রেক্ষাগৃহে (বহরমপুরের ‘রবীন্দ্র ভবন’-এর মত কিছু প্রেক্ষাগৃহ বাদে) আলোর যেটুকু সরঞ্জাম যেখানে যে অবস্হায় শুরুতে ঝোলানো হয়েছিল সেখান থেকে কোনোভাবেই নড়ানোর কোনো নিয়ম চালু নেই; চাই নাটক হোক বা না হোক তাতে সরকারের বা প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষের কিছু যায় আসে না। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে এন.এস.ডি. ব্যতীত অন্যান্য সরকারী প্রেক্ষাগৃহের কোনো নিয়মকানুন-এর কথা অবশ্য আমাদের জানা নেই।

এবারে অভিনয়পর্বের আলোচনা দিয়ে ইতি টানা যাক্‌।এই অংশটি আমরা তিন ভাগে আলোচনা করতে পারি, শুরুতে আসা যাক্‌ স্বাতী দি এবং সোহিনীর কথায়। ভীষণ সুন্দর অনবদ্য অভিনয় দুইজনেরই। অল্প কিছু জায়গায় একটু অতিরঞ্জন বাদ দিলে সমস্ত জায়গায় সোহিনীর সাবলীল অভিনয় দর্শক মন ভরিয়ে তুলেছে। সেই সাথে স্বাতী দি –কিছু না হলেওবয়স এখন সত্তর-এর কাছাকাছি তো বটেইএই বয়সেও তার যে দেহভঙ্গী এবং সুরেলা কন্ঠস্বর, সেটা যেকোনো মাঝবয়সী অভিনেতাকেও হার মানায়। যদিও একেবারে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের শেষ সারিতে বসা দর্শকদের কানে স্বাতী দির গানের কলি খুব একটা পৌঁছায় নি কিন্তু সেটা আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নাই ধরতে পারি কারণ সমস্ত সংলাপ কিন্তু তিনি নিশ্চিতভাবেই পিছনের সারিতে পৌঁছিয়েছেন। দিদি, আপনার মতন এমন sensitive performer দের জন্য আরো অনেক ভালো প্রেক্ষাগৃহ প্রয়োজন জানি, কিন্তু...???

দ্বিতীয় পর্বে আসা যাক্‌ রুদ্র দা এবং দেবশঙ্কর হালদারের কথায়। রুদ্র দার যেমন অভিনয় গুণ তেমন কন্ঠস্বর এসব সকলি আমাদের জানা। তবুও কেন জানি মনে হয়েছে রুদ্র দা হয়তো তার নিজের চরিত্রের মধ্যে একটু যেন অনুপস্হিত ছিলেন। আবার খুব চৌকস অভিনেতা বলেই সকল দ্বন্দ্ব থেকে খুব সহজেই তিনি নিজেকে উতড়িয়ে নেন। দেবশঙ্কর হালদার – মাসের ত্রিশ দিনে যার ত্রিশটি ভিন্ন নাটকের শো থাকে মঞ্চে (শোনা কথা), তার অভিনয়ের কথা আমরা আলোচনা করি কোন্‌ মুখে। তবে আজ থেকে কয়েক বৎসর আগে ‘রুদ্ধ সঙ্গীত’ নাটকের দেবশঙ্কর আর এই দেবশঙ্করের একটা পার্থক্য আজ কোথায় যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। দুটো নাটকই তো কোলকাতার এই সময়ের দুই বিখ্যাত নাট্যদলের হাউকফুল শো। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? পরে কখনও জেনে নেওয়া যাবে অন্য কোনো ভাবে।

তৃতীয় পর্বে আলোচিত হতে পারে বাকী সকল অভিনেতার কথাখুব একটা একক অভিনয় না থাকলেও কোরাসে তাদের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। পুরো টীমটাই একেবারে তারুণ্যে ভরপুর। বেশ ভালো তাদের Strength কিন্তু কোথাও কোথাও ছন্দপতনের ব্যাপারে তাদের একটু বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। কারণ এই ধরণের নাটকে কোরাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও নির্দেশক তাদেরকে ব্যবহার করার risk খুব একটা নেওয়ার সাহস করেননি বলেই মনে হয়। নিলে হয়তো এই নাটকের আঙ্গিকটাই পাল্টে যেতে পারত। তাহলে আর কিছু না হোক্‌, নামকরণের সার্থকতাটুকু প্রকাশ পেত হয়তো।

Comments

Popular posts from this blog

নাট্য আলোচনা - রাজা

বাংলা ভাষার ‘প্রথম’ নিদর্শন গীতগোবিন্দ কাব্য

Book Review: প্রগতির চেতনা প্রগতির পথিকেরা

জামাইষষ্ঠীর ইতিহাস

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ‘প্রতীক’ (The Logo of IPTA)

আমার মা

ঘরোয়া সিরিজ: শুচিবায়ী বাঙালী