জামাইষষ্ঠীর ইতিহাস


    আজ জামাইষষ্ঠী। বাংলার হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের ঘরে ঘরে একটি অত্যন্ত আনন্দের উৎসব হিসেবে এই জামাইষষ্ঠী উদ্‌যাপিত হয়। কিন্তু আসলে কেন এই উৎসব, কি কারণে হয় তা কি আমরা কেউ জানি। হয়তো বা জানি। আবার হয়তো বা জানি না। আবার হয়তো যেটা জানি সেটা ঠিক না।


    যাহোক্‌, আমরা সকলেই একটা বিষয় জানি যে, বাংলার ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের। কিন্তু সেই ইতিহাসে জামাইষষ্ঠী বলে কোনো উৎসবের নাম আমরা মোটামুটি ঊনবিংশ শতকের আগে সেইভাবে কোথাও কোনো উল্লেখ পাইনা। এবার প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কেন এবং কি কারণে আগে ছিল না কিন্তু পরে যোগ হলো।


প্রথমেই বলে নেই আসলে কি হয় এই দিনটিকে ঘিরে। এদিন আসলে মা ষষ্ঠীর পূজো হয়। মা ষষ্ঠি মূলত শিশুদের রক্ষাকারী একজন লৌকিক দেবী। তিনি সন্তানকে যেমন রক্ষা করেন আবার সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সময় মাকে সকল বাধা বিঘ্ন থেকেও দূরে রাখেন বলে সাধারণে বিশ্বাস। সে কারণে সন্তানের কল্যানার্থে মায়েরা এই দিনে এই পূজো করে সন্তানকে আশীর্বাদ দিয়ে থাকেন। এছাড়া সন্তান ধারণ কালে গর্ভবতী মায়ের ষষ্ঠ মাসে মা ষষ্ঠীর পূজো করে গর্ভবতী মাকে সুস্হ্য সন্তান কামনায় সকলে আশীর্বাদ করে থাকেন।


    এবার আসি সার্বজনীন মতে কীভাবে এই দিনটি মা ষষ্ঠীর পূজো থেকে জামাইষষ্ঠীতে রূপ নিল। লোকে বলে, আগের দিনে একটি সংস্কার ছিলো মেয়ে বিয়ে হয়ে গেলে সন্তান ধারণ না করা পর্যন্ত বাবা মা তার মেয়ের সাথে দেখা করতে পারতেন না। পরবর্তীকালে সন্তান ধারণে দেরী বা অপারগতার কারণে সেই নিয়মের একটু পরিবর্তন সাধিত হয়। আবার এখনকার প্রথা অনুযায়ী যিনি কন্যা দান করবেন তিনি কণের শ্বশুরালয়ে এক বৎসর কাল কিছু অন্ন গ্রহণ করতে পারবেন না। এবার তাহলে মেয়ের মুখদর্শন কি করে হবে? তখন আমাদের এই সমাজ জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লাষষ্ঠীর এই দিনটিকে বেছে নিল জামাইষষ্ঠী হিসেবে। যেদিন জামাইকে নিমন্ত্রণ করে বিশাল আয়োজন পূর্বক সমাদর করা হবে আর মেয়ের মুখও দেখা হবে। সাথে অবশ্যই মা ষষ্ঠীর পূজো করে তাদেরকে আশীর্বাদ করা হবে তাড়াতাড়ি সন্তানলাভের আশায়।


    এবার আসি, আমার মতে কেন এবং কীভাবে জামাইষষ্ঠীর চল এলো। আমরা একটু ইতিহাস ঘাটলেই জানতে পারব ‘কুলীন বিবাহে’র কথা। সেই সম্পর্কে বিস্তারিত এইখানে লিখতে চাইনা। কেউ চাইলে খুব সহজেই সে সম্পর্কে জানতে পারবেন। শুধু এটুকুই বলি, সেই সময়ের সমাজে কুলীন ব্রাহ্মণরা শতাধিক বিবাহ পর্যন্ত করত। সেই বিবাহতে বয়স কোনো বাধা ছিলো না। এমনকি কাল মারা যাবে আজ বিবাহ করে কন্যাদায়গ্রস্হ পিতাকে কন্যা দায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন এমনও ঘটনা বিরল নয়। তাদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিল যারা কোনো কর্ম না করে বছরের পর বছর শ্বশুর বাড়ী ঘুরে ঘুরে দিনানিপাত করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেটা ছিল, এই কুলীনদের মনেই থাকত না কাকে তারা বিয়ে করেছে। কোন্‌ গ্রামের কোন্‌ ঘরে তার কয়টা বউ আছে। অনেকে আবার সময়ে সময়ে লিষ্ট করে রাখতো। কেউ কেউ আবার সেই বাড়ী থেকে লিষ্ট অনুযায়ী প্রতি মাসে মাসে মাসোহারা নিত। মূল কথা কুলীন বিবাহ প্রথায় স্ত্রীর দায়ভার বহন করার কোনো বিধান ছিল না; উল্টে জামাইদের দায়ভার নিতে হতো মেয়ের বাবার। এমনি সময়ে শুরু হলো এই জামাইষষ্ঠীর চল। জামাইকে বছরের কিছুটা সময় মেয়ের কাছে রাখতে মেয়ের বাবারা এই ষষ্ঠীর দিনটাকে বেছে নিলেন। আর কুলীনরাও সুযোগ বুঝে যেখানে বেশী নজরানা পেত সেখানেই যেত। যার ঘরে যেত সেই মেয়ের সুখ দীর্ঘস্হায়ী হতো। তেমন বুঝে মেয়ের বাবারাও খরচ করতেন। তারা সেদিন মা ষষ্ঠীর পূজো করে কন্যা এবং তার জামাইকে আশীর্বাদ করতেন শীঘ্র সন্তান লাভের আশায়। কারণ সন্তান এলেই ভালোবাসা বাড়ে এটা তো আমাদের আজন্ম বিশ্বাস। আর বিশ্বাস থেকেই ধীরে ধীরে এই সমাজে শুরু হয়েছে ষষ্ঠী পূজোর দিনে জামাইষষ্ঠীর চল।


    আজ আর কুলীন বিবাহ নেই, সেটা আইন করে রহিত হয়েছে। কিন্তু একটু অন্যভাবে হলেও জামাইদের জামাই আদরের চলটা কিন্তু রয়েই গেছে।  

Comments

  1. দারুণ ।
    আবেগ, তথ্য এবং যুক্তি সঙ্গত।

    ReplyDelete
  2. Bondhu tui taratari biye kor....

    ReplyDelete
    Replies
    1. Coronar sudur proshari hat shob kichu tei lock down kore rekheche...ki kori bondhu...

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

নাট্য আলোচনা - রাজা

বাংলা ভাষার ‘প্রথম’ নিদর্শন গীতগোবিন্দ কাব্য

Book Review: প্রগতির চেতনা প্রগতির পথিকেরা

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ‘প্রতীক’ (The Logo of IPTA)

আমার মা

ঘরোয়া সিরিজ: শুচিবায়ী বাঙালী