ঘরোয়া সিরিজ - "রাখীবন্ধন উৎসব ও রবীন্দ্রনাথ"


        'রাখীবন্ধন উৎসব' কীভাবে বাঙালী জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠল সে বিষয় নিয়েই আজকের এই ছোট্ট আলোচনা। কয়েকদিন ধরেই আমি ‘ঘরোয়া সিরিজ’ নামে একটা সিরিজ লিখছি। ঘরোয়া অবন ঠাকুরের স্মৃতিকথার বয়ানে রানী চন্দের লেখা একটি Memoirs। এই সিরিজের সবগুলো গল্পই ঘরোয়া গ্রন্হ থেকে নেওয়া। গ্রন্হটি নিয়ে অল্পবিস্তর কথা “Book Reviewঘরোয়া পর্বটিতে লেখা আছে।

        প্রথমেই বলে রাখা ভালো 'রাখীবন্ধন উৎসব' হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাই-বোনের মধ্যকার অটুট বন্ধনের একটি উৎসব। কিন্তু এটি বাঙালী হিন্দু সমাজে কখনোই ছিল না। মূলত এটি উত্তর ভারতের সামাজিক প্রথা অনুসারে প্রচলিত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই উৎসবের কিছু পৌরাণিক কাহিনীও প্রচলিত রয়েছে। সেটি অনলাইনে লভ্য। খুব সহজেই পড়ে নেওয়া সম্ভব।

        আজ ২৫শে বৈশাখ। গুরুদেবের ১৫৯ তম জন্মদিন। তাকে স্মরণ করেই আজকের এই ঘরোয়া আয়োজন। এই ঘটনাটি বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকের ঘটনাই বলা যায়। সম্ভবত ১৯০৫ সাল। চারিদিকে তখন স্বদেশী স্বদেশী রব উঠেছে যেন। চতুর্দিকে স্বদেশী জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি। ‘সবার ভিতরেই যেন একটা তাগিদ এসেছিল। কিন্তু কে দিলে তাগিদ। সবাই বলে, হুকুম আয়া’। কিন্তু এই হুকুম টাই বা কে দিচ্ছিল। তা কিন্তু কেউ বলতে পারে না। ‘জানে কেবল – হুকুম আয়া’।

       এমনি এক দিনে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘রাখীবন্ধন-উৎসব করতে হবে আমাদের, সবার হাতে রাখী পরাতে হবে’। ব্রিটিশরা যখন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয় - তার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই রাখীবন্ধন উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। এই ইতিহাসের কথা আর এখানে নয়। এগুলো কমবেশি আমরা সকলেই জানি। আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো, সেইদিনের হয়ে যাওয়া রাখীবন্ধন উৎসবে কি কি ঘটেছিল।

       উৎসব মানে তো উৎসবই। কিন্তু সেটা পালনের জন্য তো একটা সূচী চাই। সেই সময়ের উৎসব তো আর আজকের মত ছিল না। চাইলাম আর - যা হোক কিছু একটা হয়ে গেল। তার উপর বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিবাদ হিসেবে উৎসব। তার একটা আলাদা মাত্রা তো অবশ্যই ছিল। আর রবীন্দ্রনাথ সেটা ভেবেছেন যখন তার তো একটা আলাদা কেতা থাকবেই। ‘ঠিক হল সকালবেলা সবাই গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখী পরাবে’। গুরুদেব বললেন, ‘সবাই হেঁটে যাব, গাড়িঘোড়া নয়’। স্মৃতিকথায় অবন ঠাকুর বলছেন, ‘আমার একদম হাঁটতে ভালো লাগে না’। কিন্তু কি করা যাবে ‘রবিকাকার’ হুকুম হয়েছে যে। আর ‘হেঁটেই যখন যেতে হবে, চাকরকে বললুম, নে সব কাপড়-জামা, নিয়ে চল সঙ্গে। তারাও নিজের নিজের গামছা নিয়ে চলল স্নানে, মনিব চাকর একসঙ্গে সব স্নান হবে’। এক অভূতপূর্ব পরিবেশ নিশ্চয়ই হয়েছিল সেদিন।। এমন দৃশ্য বাঙলাদেশ আগে কখনো দেখেনি। কোনো রকম কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয় না কোনো ধর্মীয় পদযাত্রা। এ যে মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন। ‘রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাথ অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে – মেয়েরা খৈ ছড়াচ্ছে, শাঁক বাজাচ্ছে, মহা ধুমধাম – যেন একটা শোভাযাত্রা’। পথ দিয়ে মিছিল চলেছে গান গাইতে গাইতে। দিনু (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) গান ধরেছে –

বাংলার মাটি, বাংলার জল,

বাংলার বায়ু, বাংলার ফল –

পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।।

‘এই গানটি সেই সময়েই রচিত হয়েছিল’। সকাল থেকেই ঘাটে লোকে লোকারণ্য। স্নানের সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথকে দেখবার জন্য চারিদিকে ভিড় জমে গিয়েছিল। সাথে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এক গাদা রাখী – স্নান সেরে একে অপরের হাতে রাখী পড়াতে লাগল। ‘হাতের কাছে ছেলেমেয়ে যাকে পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বাদ পড়ছে না, সবাইকে রাখী পড়ানো হচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সে এক ব্যাপার’। সত্যি, এটা ব্যাপারই বটে। ভাবা যায় না। সেই সময়ের কোলকাতায় দাঁড়িয়ে রাস্তায় মেয়েদেরকেও রাখী পড়ানো হচ্ছে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার।

       এরপরে যা ঘটল সেটা আরো এগিয়ে। অবন ঠাকুর বলছেন, পাথুরিয়াঘাটা দিয়ে আসতে আসতে দেখা যাচ্ছে ‘বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতকগুলো সহিস ঘোড়া মলছে, হঠাৎ রবিকাকারা ধাঁ করে বেঁকে গিয়ে ওদের হাতে রাখী পড়িয়ে দিলেন। ভাবলুম রবিকাকারা করলেন কী, ওরা যে মুসলমান, মুসলমানকে রাখী পরালে – এইবারে একটা মারপিট হবে। মারপিট আর হবে কী। রাখী পরিয়ে আবার কোলাকুলি, সহিসগুলো তো হতভম্ব, কাণ্ড দেখে’। হতভম্ব হওয়ার মতই তো ব্যাপার। মনিব স্হানীয় ব্যক্তিরা তাদের রাখী পড়াচ্ছে, কোলাকুলি করছে।

       এদিকে এগোতে এগোতেই রবীন্দ্রনাথের মাথায় অন্য ভূত চাপে। ‘হঠাৎ রবিকাকার খেয়াল গেল চিৎপুরের বড় মসজিদে গিয়ে সবাইকে রাখী পরাবেন। হুকুম হল, চল সবাই। এইবারে বেগতিক – আমি ভাবলুম, গেলুম রে বাবা, মসজিদের ভিতরে গিয়ে রাখী পরালে একটা রক্তারক্তি ব্যাপার না হয়ে যায় না’। এই বলে অবন ঠাকুর অবসর পেতেই সেখান থেকে সরে পড়লেন। এদিকে রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে চলেছেন সোজা মসজিদের দিকে, কোনো দিকে খেয়াল নেই। সঙ্গে ছিল দিনু, সুরেন (সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর), আরো অনেকে।

       এক থেকে দেড় ঘন্টা বাদে সবাই ফিরে এলেন বাড়ি। ‘আমরা সুরেনকে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কী, কী হল সব তোমাদের। সুরেন যেমন কেটে কেটে কথা বলে, বললে, কী আর হবে, গেলুম মসজিদের ভিতরে, মৌলবী সহ যাদের পেলুম হাতে রাখী পরিয়ে দিলুম। আমি বললুম, আর মারামারি! সুরেন বললে, মারামারি কেন হবে – ওরা একটু হাসলে মাত্র’।

       সেই থেকে শুরু হয়ে গেল স্বদেশী কালের ফল - বাঙালীর ‘রাখীবন্ধন উৎসব’। আজো সারা বাঙলায় এই উৎসব কিন্তু একযোগে সকল সম্প্রদায়ের মানুষজনের মিলনের উৎসব হিসেবেই পালিত হয়। এবার তাহলে পাঁজির কথাটা সেরে নেওয়া যাক্‌। অনুষ্ঠান সূচী সাজাতে যখন হল্লা হচ্ছে তখন ক্ষেত্রমোহন কথক ঠাকুরকে গিয়ে বলাতে উনি খুব উৎসাহের সহিত অনুষ্ঠান সূচী বাৎলে দিয়েছিলেন। তন্মধ্যে যে উল্ল্যেখযোগ্য কাজটি তিনি করেছিলেন তা হলো, ‘তিনি খুব খুশি ও উৎসাহী হয়ে উঠলেন, বললেন, এ আমি পাঁজিতে তুলে দেব, পাঁজির লোকদের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে, এই রাখীবন্ধন উৎসব পাঁজিতে থেকে যাবে’। তখনকার দিনে তো আর ডেস্ক ক্যালেণ্ডার বা ওয়াল ক্যালেণ্ডার ছিল না। ছিল শুধু পাঁজি বা পঞ্জিকা। সেই থেকে এই উৎসবের দিন ধার্য হয়ে আছে পাঁজিতে।

       এই আমাদের অন্য এক অচেনা রবীন্দ্রনাথ। এই রকম কত সহস্র কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি শুধু কলমের খোঁচায় গান, কবিতাই রচনা করেননি; সমাজ সংস্কারে তাঁর যে উল্ল্যেখযোগ্য রকমের ভূমিকা ছিল তার বহু প্রমাণ মেলে।

Comments

Popular posts from this blog

নাট্য আলোচনা - রাজা

বাংলা ভাষার ‘প্রথম’ নিদর্শন গীতগোবিন্দ কাব্য

Book Review: প্রগতির চেতনা প্রগতির পথিকেরা

জামাইষষ্ঠীর ইতিহাস

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ‘প্রতীক’ (The Logo of IPTA)

আমার মা

ঘরোয়া সিরিজ: শুচিবায়ী বাঙালী