EXHIBITION REVIEW - অতীত ও বর্তমানের বন্ধন – একটি প্রদর্শনী ও আমাদের শান্তিনিকেতন


প্রকাশ: Thespian Magazine (ISSN 2321-4805)

Volume: 4
Issue: 1
Edition: Autumn Edition
প্রকাশকাল: ২০১৬
Edited by: Prof. Abhijit Sen, Professor, Deptt. of English, Visva-Bharati, Santiniketan






অতীত ও বর্তমানের বন্ধন – একটি প্রদর্শনী ও আমাদের শান্তিনিকেতন

বিভাস বিষ্ণু চৌধুরী

ঘুরে এলাম এক বিচিত্র দেশে। যেখানে রবীন্দ্রনাথকে দেখলাম কিন্তু ছুঁয়ে দেখতে না পারার নিরানন্দ নিয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু অনুভব করলাম এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে, অন্য শান্তিনিকেতনকে একেবারেই একজন ভিনদেশী সঙ্গীতজ্ঞের চোখে বা বলা ভাল তার লেন্সে।

বিচিত্র এই দেশটি কোনো ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক সীমারেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত আয়তাকার, বর্গাকার বা অন্য কোনো আকারের ক্ষেত্রবিশেষ নয়। এটি একটি চিন্তার দেশ - সাথে ছিল ভাবনা আর বিশ্বাস। খুব সহজ কথায় বল্লে বলা যায় একটি ‘প্রদর্শনী’। এমন এক ‘প্রদর্শনী’ যাকে কোন্‌ ভাগে বিশেষায়িত করব সেটা এই লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত যদি আকার নেয় তাহলে সেটাই হবে এই আলোচনাটির শিরোনাম। আপাতত থাক্‌।

যাহোক্‌, গত ৭ হতে ১৫ই মার্চ ২০১৬ শান্তিনিকেতনের ‘নন্দন’ প্রদর্শনী হলে প্রদর্শিত হলো ‘The Travelling Archive’-এর একটি Audio-visual প্রদর্শনী যার সার্বিক গবেষণা ও উপস্হাপনায় ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী ও লেখক মৌসুমী ভৌমিক এবং প্রদর্শনীর পরিকল্পনা ও রূপকল্পে ছিলেন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট সুকান্ত মজুমদার। ‘The Travelling Archive’ মূলত এই দু’জনেরই সৃষ্টি। আর তাদের সহযোগী ছিলেন ইয়ান-সাইমন সোয়ার্টস। এছাড়া প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত ছবির প্রদর্শনকল্পনায় ছিলেন চিত্রগ্রাহক রনি সেন ও ত্বিষা দেব। প্রদর্শনীর শিরোনাম হলো ‘Time upon Time: Arnold Bake in Bengal’

কে এই Arnold Bake (আর্নল্ড বাকে)?

প্রদর্শনীর বাংলা ক্যাটালগের মুখবন্ধে গবেষক লিখছেন,
আর্নল্ড বাকে (১৮৯৯-১৯৬৩) তাঁর হল্যান্ডের মাষ্টারমশাই, প্রত্নতত্ত্ববিদ ফিলিপ ভোগেল এবং সংস্কৃতজ্ঞ উইলেম কালান্ড-এর অনুপ্রেরণায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকর্ষণে ২৬ বছর বয়সে স্ত্রী কর্নেলিয়াকে সঙ্গে করে শান্তিনিকেতনে আসেন। আপাতভাবে উদ্দেশ্য ছিলো ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্হ সঙ্গীতদর্পণের বিশ্লেষণ, কিন্তু এমনিতেই তাঁর নানা বিষয়ে উৎসুক মন ও মনন, তায় এসে পড়েছেন শান্তিনিকেতনে, ...[আর তাই] সঙ্গীতদর্পণকে অতিক্রম করে বাকে’র জ্ঞানচর্চা নানা দিকে ধাবিত হয় এবং শান্তিনিকেতনের ভূগোল পেরিয়ে তিনি কাছে, দূরে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান প্রধানত গান বা আর কোনো সুর-স্বর-তাল-ছন্দ শোনা এবং তাকে বিভিন্ন উপায়ে ধারণ করার জন্য।

প্রথম দফায় (১৯২৫-২৯) যখন আর্নল্ড বাকে ভারতে আসেন, তখনও পর্যন্ত তাঁর কাছে শব্দ রেকর্ড করার জন্য কোনো যন্ত্র ছিল না (অন্তত এখনো পর্যন্ত আমরা তেমনই জেনেছি)। যা শুনতেন, যা কানে আর মনে ধরতো, তার কথা কখনো মা’কে চিঠিতে জানাতেন, ফটো তুলে পাঠাতেন কখনো, অনেক সময় সেই সুর আর গান নিজে শেখার চেষ্টা করতেন, শিখেও ফেলতেন নিজের মতন করে, ...অদ্ভুত [তার] কম্বিনেশন, আইরিশ গান, রাশিয়ান গান, রবি ঠাকুর, ভাটিয়ালি, শুবার্ট (আর্নল্ড বাকে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুগায়ক ছিলেন এবং তাঁর স্ত্রী পিয়ানো বাজাতেন) [প্রভৃতি]। কোনো কোনো গানের আবার নোটেশনও করে রাখতেন। এইভাবেই ১৯২৬-এর ফেব্রুয়ারী মাসে রবীন্দ্রনাথের ‘বড়দাদা’ দ্বীজেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের কথা মা’কে লিখতে গিয়ে আশ্রমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ‘ব্রাক্ষণ শিক্ষক’ ও ছাত্রদের বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ তাঁকে কতখানি মুগ্ধ করেছিল, সেই কথা জানিয়েছিলেন – ‘কী অপূর্ব যে লাগছিল তানপুরার সঙ্গে গাওয়া সেই সুর!’ কোথায় হচ্ছিল সেই অনুষ্ঠান, তা বোঝাতে গিয়ে মা’কে ছাতিমতলার একটা ছবি তুলে, পিছনে ক্যাপশন লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

এই তার শান্তিনিকেতনে আসা। এর পর যতবারই তিনি দক্ষিণ এশিয়াতে এসেছেন ততবারই শান্তিনিকেতনে এসেছেন।

‘...দ্বিতীয়বার বাংলায় তথা ভারতে ফিরে আসেন ১৯৩০-এ। এবার তিনি সঙ্গে করে রেকর্ডিং-এর যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন। প্রথমবার তাঁর শান্তিনিকেতনে বিশেষ ভাব হয়েছিল ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে। ...ক্ষিতিমোহনের কাছে তিনি বাউল এবং উত্তর ভারতের ভক্তিবাদ সম্পর্কে জেনেছিলেন। ফলে, রেকর্ডিং-এর যন্ত্রপাতি নিয়ে আসার পর, কেন্দুলি [যেখানে ‘জয়দেবে মেলা’ হয়] ছিল বাকের স্বাভাবিক গন্তব্যস্হল। বাউলের গান, কীর্তন, পথে শোনা টুকরো বাঁশির সুর, সাঁওতালদের মাদল – এক সুর থেকে আর এক সুরে যেতে লেগেছিলেন আর্নল্ড বাকে। মঙ্গলডিহির সিঙ্গা আর ময়নাডালের খোলের জটিল বোল ধরা পড়ছিল তাঁর রেকর্ডিং যন্ত্রে, কলকাতায় নবদ্বীপ ব্রজবাসী মহাশয়ের কীর্তন রেকর্ড করছিলেন; আর শান্তিনিকেতনে সাবিত্রী গোবিন্দের মীরা-কবীর-মীনাক্ষী, লক্ষ্মীশ্বর সিনহার ‘সিলেটি’ লোকগান এবং বীরেশ্বর চক্রবর্তীর ভাটিয়ালি। এমনকি গুরুদয়াল মল্লিক মহাশয়ের পাঞ্জাবি গান পর্যন্ত। সিউরি মেলায় গিয়ে ময়মনসিংহের জারিগান শুনছিলেন, কেন্দুলিতে বাউল শোনার ফাঁকে রুমাল উড়িয়ে নেচে নেচে গান গাওয়া বাঁকুড়ার বাউরি মেয়ে কুসুমের ঝুমুর গান আর নাচের ছবি তুলছিলেন; ক্যামেরা ঘুরে যাচ্ছিল মন্দির আর অজয় নদের ওপর সার বাঁধা পূণ্যার্থীর দিকে’।

          সে কি অপূর্ব দৃশ্য। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সেই সময়ের শান্তিনিকেতন, কেন্দুলি প্রভৃতি স্হান ও নানান অনুষ্ঠানের নৃত্য, বাদ্য ও অন্যান্য দৃশ্যাবলীর এক অনন্য চলচ্ছবি। যদিও শব্দহীন তবুও ক্যামেরার লেন্সে কান পেতে শুনেছি সেই শব্দ। অসাধারণ একটি দৃশ্যচিত্র। এর আগে ৬০-এর দশকে শান্তিনিকেতনের উপর একটি তথ্যচিত্র করেছিল ভারত সরকারের ‘ফিল্ম ডিভিশন’। সেটা দেখা ছিল। কিন্তু ততদিনে এটা পুরোপুরি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বাকে’র টুকরো টুকরো দৃশ্যচিত্র দ্বারা নির্মিত চলচ্ছবি যেটা ৯দিন ধরে ‘নন্দন’ প্রদর্শনী হলে প্রদর্শিত হলো তা সত্যিই অনবদ্য; এক অন্য শান্তিনিকেতনের ছবি। যেখানে শুধু বড়দের মুখের গল্প শুনে আর বই পড়ে মনের ভিতরে নিজ অঙ্কিত একটি ছবি থেকে বেরিয়ে সত্যি সত্যি সেই সময়ের শান্তিনিকেতনের একটি ছবি মানসপটে এঁকে দিয়ে গেল এই প্রদর্শনীটি।

Comments

Popular posts from this blog

নাট্য আলোচনা - রাজা

বাংলা ভাষার ‘প্রথম’ নিদর্শন গীতগোবিন্দ কাব্য

Book Review: প্রগতির চেতনা প্রগতির পথিকেরা

জামাইষষ্ঠীর ইতিহাস

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ‘প্রতীক’ (The Logo of IPTA)

আমার মা

ঘরোয়া সিরিজ: শুচিবায়ী বাঙালী