আমার মা

       আজ বিশ্ব মা দিবস। পৃথিবীর কোনো দিবস নিয়েই আমার আসলে ততোটা মাথাব্যথা নেই। ধর্মীয় দিবস হলে তো কথাই নেই – I hate all this। ঘটা করে কোনো দিবস উদ্‌যাপন করতে আমার কখনোই ভালো লাগে না। কিছু কিছু দিন আছে খুবই ব্যক্তিগত স্তরে থাকলেই ভালো লাগে। যাই হোক্‌, সকলের মতো মাকে আমিও ভীষণ ভালোবাসি। কিছুটা প্রেমিকার মত। এমনই সে ভালোবাসা যে আমার প্রেমিকা মাঝে মাঝে বলে ফেলে – ‘আমি কি তোমার ‘মা’ নাকি’। তখন আমার নিজের এই ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খাটাকে imagine করে ভয়ে শিহরিত হই। আমরা খুবই পবিত্রতার সহিত মাকে মনে করি সবসময়। মোদ্দা কথা, মাকে ঈশ্বর জ্ঞানে ভক্তি করি। ঈশ্বর প্রেমের মতই সেটি পবিত্রতায় মোড়া। আর সেখানেই আমার মনে এক প্রশ্নের উঁকি দেয় যে, এত প্রেমের মাঝে কোথাও মায়ের একান্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করছি না তো।

       ‘মা’ শব্দটিকে ঘিরে আমার নানা সময় নানা ধরণের ভাবনা তৈরী হয়েছে। যেটুকু মনে দাগ কেটেছে সেগুলোকে ঘিরেই এই উত্তর খোঁজার ক্ষুদ্র চেষ্টা মাত্র। আমাদের সমাজে আমরা ‘মা’কে একটি institution বলেই মানিযেখানে ‘মা’ শব্দটির সম্মান রক্ষার্থে কোনো কিছুতেই কোনো Mercy করিনা আমরা। ভালো কথাতাতে আমারও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই Institute –এর প্রতি এক উন্মাদ ভালোবাসায় আমাদের অনেক কিছুই চোখ এড়িয়ে যায় বা আমরা দেখেও না দেখার ভান করে ফেলি যাতে ‘মা’ শব্দটির পবিত্রতা নষ্ট না হয়ে যায়।

       এই সমাজে এমন অনেক মা আছেন যারা বাবাদের কর্তৃক ভয়ঙ্করভাবে প্রহৃত হন অথবা নিজ সন্তানের সামনে চরমতম অপমানিত হন দিনের পর দিন। সেই মায়ের কান্নায় আমরাও হয়তো কেঁদে বুক ভাসাই। তার প্রতি সমবেদনায় মুসড়ে পড়ি। কারণ আমরা তার শরীরের অংশ বলেই হয়। সেই সাথেই হয়তো অল্পবিস্তর বাবার প্রতি একটা ঘৃণা জন্মায়। কিন্তু তারপরেও আমরা কি কখনো মা কে বলি তুমি বাবাকে ত্যাগ করে নতুন জীবন শুরু করো অন্য কাউকে নিয়ে। আমরা আমাদেরটা ম্যানেজ করে নেব। বলি কি? না বলি না। কেন? কারন তাকে আমরা ‘মা’ বানিয়ে রেখেছি। ‘মা’-র criterion–এর মধ্যে এটা পড়ে না। আর এভাবেই আমরা installed

       অদ্ভুতভাবে ‘মা’রাও এটা কখনো ভাবতে পারে না। কারন তাকে যে ‘মা’ বানিয়ে রেখেছে সমাজ। সে একটি পবিত্র institution। তার দায়িত্ব অনেক যেটা সমাজ দিয়ে রেখেছে। ‘মা’ চাইলেই সবকিছু করতে পারেনা। কিন্তু ‘বাবা’ পারে। কারণ সমাজ এবং ইতর ধর্ম সেই লাইসেন্স তাকে দিয়েছে। আমাদের এই সমাজে বাবা একের অধিক স্ত্রী রাখতে পারে। কিন্তু মা একের অধিক স্বামী রাখতে পারে না। কারণ সমাজ এবং ইতর ধর্ম সেই লাইসেন্স তাকে দেয়না। তাই আমরাও কখনো মাকে এইরূপে দেখতে অভ্যস্ত নই। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত মনে হয় আমার কাছে। ‘মা’ ‘মা’ করতে করতে ‘মা’কে আমরা কত ভাবেই না শিকলে বেঁধেছি।

       অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে। তথ্য উপাত্ত দিয়ে সাজিয়ে দেখাতে ইচ্ছা করছে আমরা কত নোংরা মানসিকতা নিয়ে এই ‘মা’ ডাক উচ্চারন করি যার লাইসেন্স সমাজ এবং ইতর ধর্ম আমাদেরকে দিয়েছে। তবে সেই বিষয়ে অধিক দৃষ্টিপাত করলে আমাদের মূল বিষয়টা লঘু হয়ে যেতে পারে। তাই ক্ষান্ত হলাম।

       আমি আমার ‘মা’ কে কখনো এমন কথা বলেছি কিনা মনে পড়ে না যে, তুমি কি করে ৪০টা বছর একজন মানুষের সাথে সংসার করে কাটিয়ে দিলে – Without any question। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন আমাকে যে, কেন, বাবাও তো ৪০টা বছর কাটিয়েছে। তাহলে ‘মা’কে নিয়ে শুধু বলছি কেন। এই প্রশ্নের খুব সহজ উত্তর আছে। তা হলো, আমরা না চাইলেও করোনার প্রকোপে সারা পৃথিবী আজ গৃহবন্দী। কেমন লাগছে আমাদের – সেই বন্দীত্ব জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একটি কথাও খরচ করার প্রয়োজন নেই। আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। আমাদের মায়েরা ৪০ বছর ধরেই কিন্তু এই বন্দীত্ব জীবন হাসতে হাসতে কাটিয়ে দেয়। বন্দী হিসেবে কিন্তু নয়, শুধুই ভালোবেসে – Without any question। আমরা সেই ভালোবাসার ফায়দা তুলি নিজের মত করে মাকে নিয়ে নানান বিশেষণ দিয়ে। এমনও মায়েরা আছে যারা শেষ ১ বছর বাড়ীর চৌকাঠের পরের পৃথিবীটা কেমন হয় তা দেখেননি। যদিও সেই সম্পর্কে তারা বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল নয় বা তাদের অভিযোগও নেই কোনো। কিন্তু এই ৪০ বছর ধরে তো বাবাদের সেই কোয়ারিন্টাইনে কাটাতে হয়না।

       সেক্ষেত্রে রোজগারের প্রসঙ্গ আসে যে, বাবাকে তো বাইরে যেতে হয় রোজগারের জন্য। আজকের দুনিয়াতে দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে কথা বলাটাই একটা Crime বলে মনে হয় আমার কাছে। নারীরা সমাজ এবং দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রমাণ করেছে কতটা রোজগেরে বা আত্মনির্ভরশীল সে হতে পারে। আর সেটা হবে নাই বা কেন। যে নারী ঘরে দুই হাতে দশ হাতের কাজ সামলায় তার চেয়ে অধিক অভিজ্ঞতা কোনো পুরুষের থাকতে পারে বলে অন্তত আমি বিশ্বাস করি না।

       অনেকেই ভাবতে পারেন আমি ফেমিনিষ্ট। একদম নই। আর মা-এর প্রসঙ্গের সাথে ফেমিনিষ্ট হওয়ারও কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ একজন ফেমিনিষ্টের কাছেও সে মা-ই। প্রকৃতপক্ষে আমি যতটা না নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করি ‘মা’-এর স্বাধীনতায়। বাস্তবে কতটা পারি সেটা আমার অভিজ্ঞতায় নেই। কিন্তু অন্তত বলতে তো পারি। পরিশেষে শুধু এটুকুই বলা যে, এই সহজ সত্যটি যতদিন না আমাদের সমাজ বুঝতে পারবে ততদিন এই সমাজ কখনো মানুষের সমাজ হতে পারবে বলে আমার মনে হয়না।

       Love you mum…

Comments

  1. লেখাটা মন ছুয়ে গেলো😍😍

    ReplyDelete
  2. জয়গুরু ।
    দারুণ দারুণ ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

নাট্য আলোচনা - রাজা

বাংলা ভাষার ‘প্রথম’ নিদর্শন গীতগোবিন্দ কাব্য

Book Review: প্রগতির চেতনা প্রগতির পথিকেরা

জামাইষষ্ঠীর ইতিহাস

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ‘প্রতীক’ (The Logo of IPTA)

ঘরোয়া সিরিজ: শুচিবায়ী বাঙালী